মাহাবুবুর রহমান, কক্সবাজার :: খুব ভোরে কক্সবাজারে অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রধান শুটকি পল্লী নাজিরারটেকে গিয়ে দেখা গেছে কয়েক হাজার নারী পুরুষ শুটকি উৎপাদনে ব্যস্ত। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ঢাকার ডেমরা থেকে আসা পর্যটক কলেজ শিক্ষক নাজিম উদ্দিন জানান, এর আগেও আমি নাজিরার টেক থেকে শুটকি নিয়ে গেছি। বাজারের চেয়ে এখানে শুটকির দাম এবং মান দুটিই ভাল। তাই সরাসরি এখানে আসলাম। পাশেই আরেক ক্রেতা জানান, আমার বাড়ি কক্সবাজারের রামু উপজেলাতে। তবে আমি দুবাইতে শুটকি পাঠাবো তাই সরাসরি নাজিরটেক থেকে কিনতে এসেছি।
বাজারে যেই ছুরিমাছ ৭০০ টাকা কেজি বিক্রি করে সেটা এখানে ৪০০টাকা দিলে কেনা যায়। এসময় শুটকি উৎপাদনকারী নাছির উদ্দিন, ফরিদুল আলম, নজির আলম বলেন, পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে শুটকির চাহিদাও বেড়ে যায়। তবে এখানে বিষ দিয়ে শুটকি উৎপাদন হয়না। জেলা মৎস্য অফিসের প্রশিক্ষণ এবং তদারকিতে সম্পূর্ন বিষমুক্ত শুটকি উৎপাদন হচ্ছে। নাজিরারটেক মৎসজীবী বহুমুখি সমবায় সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ বলেন, নাজিরারটেকে প্রায় ২০ হাজার নারী পুরুষ শুটকি উৎপাদন কাজে জড়িত। এখানে ৯৭৪ টি মাচা আছে যেখানে শুটকি শুকানো হয়। তবে আমাদের সমিতির সদস্য আছে ৫০০ জন। এর মধ্যে ৬টি সোলার ড্রয়ার আছে। তিনি জানান, শুটকির সিজন হচ্ছে ৯ মাস।
এখন প্রায় ৩ মাস চলে গেছে। সামনের দিনে আরো উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করছি। আমার জানা মতে, প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন শুটকি বিদেশে রপ্তানী হয়। তবে শুটকি উৎপাদনের সাথে জড়িতদের জীবন মান উন্নয়নে কোন পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এখনো এই নাজিরারটেকে কোন রাস্তা হয়নি, পানি বিদ্যুৎ সুবিধা নেই, সরকারি স্কুল নেই, স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র নেই। এছাড়া সদর উপজেলার খুরুশকুল, চৌফলদন্ডি, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, টেকনাফ সহ অনেক জায়গায় শুটকি শুকানোর কাজ চলছে।
এদিকে সুগন্ধাবীচ সড়কের শুটকি দোকানদার নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের দোকানে প্রায় ৪০ প্রকার শুকটি আছে। এর মধ্যে গ্রাহকদের চাহিদা হচ্ছে ছুরি,লইট্যা,চান্দা,পোকা,কোরাল,মাইট্যা ইত্যাদি। এখন বেচা বিক্রি ভালই হচ্ছে আমার মতে আগে কক্সবাজারে পর্যটক আসলে আচার বা বার্মিজ পণ্য নিয়ে যেত। এখন প্রত্যেকে বাড়ির জন্য শুটকি নিয়ে যায় এতে শুটকির চাহিদাও বেড়েছে। আর বেশির ভাগ শুটকি বিদেশেও যাচ্ছে।
শহরের বার্মিজ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ি নাজিম উদ্দিন বলেন, কয়েক বছর আগেও বার্মিজ মার্কেটে বিভিন্ন বার্মিজ জিনিস পত্র পাওয়া যেত এখন শুটকির ব্যাপক চাহিদার কারনে অনেকেই দোকান পরিবর্তন করে শুটকির দোকান করে ফেলেছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসছে যারা বিদেশে তাদের আত্বীয় স্বজনের জন্য শুটকি নিয়ে যাচ্ছে। মূলত এখন নতুন শুটকি বের হয়েছে তাই চাহিদাও বেড়েছে। তবে কক্সবাজারের শুটকির মান দিন দিন ভাল হচ্ছে এখন আর বিষ দিয়ে কোথাও শুটকি শুকানো হয়না। বিশেষ ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ রোদে দিয়ে শুটকি শুকানো হয়।
মহেশখালীর শুটকি ব্যবসায়ি আবদুস সালাম বলেন,আমাদের মহেশখালীর বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন শুটকি উৎপাদন হয়। এখানেই একমাত্র আসল শুটকি পাওয়া যায়। কারণ আমাদের শুটকি বেশির ভাগই বোটে শুকানো। প্রতি বছর মহেশখালীতে আসা অসংখ্য পর্যটক এই শুটকি নিয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের ব্যবসার উন্নয়নে তেমন কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
জানা গেছে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮ থেকে ১০টি ট্রাক অর্থাৎ ৮০ থেকে ৯০ টন শুটকি মাছ ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যা স্থানীয় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লইট্যা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, ফাইস্যা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, ছুরি ৭০০ থেকে ৯৫০ টাকা, ছোট চিংড়ি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, ছোট পোয়া ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, রইস্যা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, রূপচাঁদা ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা, লাক্ষা ১৪০০ থেকে ১৮০০ টাকা, মাইট্যা ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, বড় চিংড়ি (চাগাইচা) ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়ে থাকে।
এছাড়াও কক্সবাজারের শুটকি মহালের মাছের গুড়ি সারাদেশে পোল্ট্রি ফার্ম ও ফিস ফিডের জন্য সরবরাহ হয়ে থাকে। ঢাকার বড় বড় ফিস ফিডের ফার্মসহ দিনাজপুর, নরসিংদী, চট্টগ্রামেও চাহিদা মেটায়। প্রতি মৌসুমে নাজিরারটেক শুটকি মহাল থেকে লইট্টা, পাইশ্যা, পোয়া, ছুরি, মাইট্যা, কেচকি, রূপচাঁদসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিদেশে রপ্তানীসহ ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে।
এদিকে কক্সবাজার জেলা মৎস কর্মকর্তা এস.এম খালেকুজ্জামান বলেন, প্রতি বছর শুটকির চাহিদা বাড়ছে। চলতি বছরে জেলায় শুটকি উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার ৬৩৭ মেট্রিকটন। যার বাজার মূল্য আনুমানিক ২০০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, শুটকি এখন পর্যটন পন্য। আগে পর্যটকরা বেড়াতে আসলে বার্মিজ পণ্য বাড়ির জন্য নিত কিন্তু এখন সবাই শুটকি নিয়ে যায়। আর বেশির ভাগ প্রবাসীরাও এখন বেশি পছন্দ করছে শুটকি। তাই বিদেশে এখন কক্সবাজারের শুটকির চাহিদা বাড়ছে। আগে শুটকির পচঁন ঠেকাতে অনেকে অজ্ঞতার কারনে মেডিসিন ব্যবহার করত, এখন আমরা মৎস অফিসের পক্ষ থেকে অবিরাম প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেই অবস্থার শতভাগ উন্নতি করতে পেরেছি। সবার উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ড্রামে বা বালতিতে পরিস্কার পানি নিয়ে সেখানে ২৫০ গ্রাম হলুদের গুড়া এবং ২০০ গ্রাম মরিচের গুড়া মিশিয়ে সেই পানিতে মাছ ডুবিয়ে শুকাতে দিলে সেই মাছে কখনো পচঁন ধরবে না বা পোকা আসবেনা। তাই মাছে লবণ বা মেডিসিন ব্যবহার করার কোন প্রয়োজন নেই। আর শুটকির মান যাচাইয়ের জন্য কক্সবাজারে একটি পরীক্ষাগার স্থাপন করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
পাঠকের মতামত: