ছুটি বাতিল করে কর্মীদের পাঠানো হচ্ছে ক্যাম্পে
অনলাইন ডেস্ক ::
উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে মানবিক সহায়তা দিতে তৎপর সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের কর্মীদের ওপর অমানবিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকার সারাদেশে সাধারণ ছুটি করার পাশাপাশি খাদ্য ও চিকিৎসাসহ জরুরি বিষয় ছাড়া যানবাহন ও নাগরিকদের চলাচলেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। কিন্তু কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খাদ্য ও স্বাস্থ্য বিষয়ে কোনো কর্মসূচি না রাখলে ড্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিল (ডিআরসি), নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি)সহ কিছু এনজিও সরকারের সিদ্ধান্ত না মেনে তাদের কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে।
অভিযোগ উঠেছে, সংস্থাগুলোর কর্মীরা ক্যাম্পের কাজে যোগদান না করলে তাদের বাৎসরিক পাওনা ছুটি, অসুস্থজনিত ছুটি থেকে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিগুলো কেটে রাখার ঘোষণাও দিয়েছে তারা। বাৎসরিক ছুটি জমা না থাকলে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি মুক্ত রাখতে ছুটিগুলোর সমপরিমাণ অর্থ বেতন থেকেও কেটে রাখা হবে কর্মীদের। মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার এমন অমানবিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে গেলে থাকছে চাকরি হারানোর ভয়।
সরকারের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রতিষ্ঠান চালু রাখা ও কর্মীদের ওপর অনৈতিক চাপ প্রয়োগ করলেও জেলা প্রশাসন থেকে এখনও তাদের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি বলে অভিযোগ এনজিও কর্মীদের। এতে চরম ঝুঁকির মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যেতে বাধ্য হচ্ছে তারা। সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে সরকারের রিফিউজি রিলিফ অ্যান্ড রিপেট্রিয়েশন কমিশনের (আরআরআরসি) দেওয়া নির্দেশনা না মানারও অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সহায়তা প্রদানকারী এনজিওগুলো তাদের কর্মীদের প্রতি অমানবিক হয়ে উঠেছে করোনা পরিস্থিতিতে।
এরই মধ্যে জাতিসংঘের আওতাধীন সংস্থাগুলো ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ অর্থাৎ ঘর থেকে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে কর্মীদের। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার মুখে উখিয়ায় গাড়ি যেতে না দিলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে গাড়ি নিয়েও কিছু সংস্থার কর্মী বাধ্য হয়েই ক্যাম্পে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, সাধারণ ছুটি ঘোষণা হওয়ার পর পর কক্সবাজারে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ায় আতংকিত হয়ে এনজিও কর্মীরা যার যার ঘরেই ফিরে গেছে। ছুটি চলাকালেই চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স, কাচামালের যানবাহন ছাড়া আর কোনো যানবাহন প্রবেশ ও বের হওয়ায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পুলিশ। এর ফলে এনজিও কর্মীদের কাজে যোগদান করতে বলায় অনেকেই যোগদান করতে পারছেন না।
একাধিক এনজিও কর্মী অভিযোগ করেন, সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ওয়ার্ক ফ্রম হোম অর্থাৎ ঘর থেকে কাজ করার নির্দেশনা দেয় ডিআরসিসহ কয়েকটি সংস্থা। মূলত যেসব সংস্থা খাদ্য ও স্বাস্থ্য সম্পৃক্ত কাজের সঙ্গে জড়িত নয় তারাই এ ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে যার যার বাসা থেকেই অফিসিয়াল কর্মকান্ড পরিচালনা করছে কর্মীরা। এমন সময় কক্সবাজারের চকরিয়ায় করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হলে কক্সবাজার ছেড়ে যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মীরা। এছাড়া টেকনাফে অবস্থান করে ঢাকা ফিরে যাওয়ার পর একজন র্যাব সদস্য করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আতংক ছড়িয়ে পড়ে উখিয়াতেও। এই এলাকাতেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প।
তারা আরও বলেন, ৪ এপ্রিল সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ ছুটি বাড়ানোর ঘোষণা দিলে ডিআরসি, এনআরসিসহ কিছু এনজিও তাদের কর্মীদের দ্রুত কর্মস্থলে যোগদান করতে বলে। তারা কর্মীদের জীবনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে এ ধরনের অমানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন অনেক এনজিও কর্মী। এনজিওগুলো কর্মীদের যোগদান না করলে সিক লিভ নিতে বলে। না হয় করোনার কারণে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিগুলো বাৎসরিক জমা ছুটি থেকে কেটে নেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দেয়। বাৎসরিক জমা ছুটি না থাকলে বা ছুটি আগে থেকে নেওয়া থাকলে আনপেইড লিভ নেওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এনজিও কর্মীদের অভিযোগ, ‘হিউম্যানিটেরিয়ান’ হয়ে ডিআরসিসহ কয়েকটি এনজিও’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের কর্মীদের উপর অমানবিক হয়ে উঠেছেন। তারা সরকারের নির্দেশনা না মানলেও জেলা প্রশাসন কিংবা সরকার তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করছে না।
তারা আরও বলেন, সরকার বা প্রশাসন গার্মেন্টসহ বিভিন্ন সেক্টরের ছুটি নিশ্চিত করতে যেভাবে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে সেভাবে কক্সবাজারের এনজিওগুলোর প্রায় চার হাজার কর্মীর ছুটির বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দিতে পারে। এমনিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এনজিও কর্মীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছে।
কক্সবাজারে কর্মরত এনজিওগুলোর সংগঠন ইন্টার-সেক্টর কো-অর্ডিনেশন (আইএসসিজি) গ্রুপের মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা গেছে, গত ২৪ মার্চ রিফিউজি রিলিফ অ্যান্ড রিপেট্রিয়েশন (শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন) কমিশনের যুগ্ম সচিব মাহবুব আলম তালুকদার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বেশ কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয় এনজিওগুলোকে। ওই নির্দেশনায় জরুরি সেবা (যেমন স্বাস্থ্য, খাদ্য) ছাড়া স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম পরিচালনা করতে বলা হয়। সে হিসেবে
জরুরি খাদ্য ও স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদানকারী এনজিওগুলোর মধ্যে আইওএম, ইউএনএইচসিআর, মুক্তিসহ কয়েকটি এনজিওগুলোক স্বল্পপরিসরে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে।
কিন্তু এই নির্দেশনার বাইরে যেসব সংস্থা সাইট ম্যানেজমেন্ট, শেল্টার অ্যান্ড ইনফ্রাসট্রাকচার, জেন্ডার বেসড ভায়োলেন্স, চাইল্ড প্রটেকশন ও লাইভলিহুড সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরিচালনা করছে তারাও তাদের কর্মীদের জোর করে ক্যাম্পে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তাজনিত কারণে গত রোববার ও বৃহস্পতিবার বেশ কিছু গাড়ি উখিয়ায় প্রবেশ করতে দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন কামাল হোসেন বলেন, ‘খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা ব্যতীত কোন এনজিও ক্যাম্পে অনুপ্রবেশ করতে করবে না। জরুরি প্রয়োজনের ক্ষেত্রেও শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।’
এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন (আরআরআরসি) কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্যাম্পকেন্দ্রিক যে সকল এনজিও শুধুমাত্র খাদ্য এবং চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত থাকবে তাদের তালিকা কিউআর কোড সম্বলিত ডাটাবেইস করে ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী ও পুলিশের হাতে প্রেরণ করা হয়েছে। এরপরও কোন সংস্থা যদি তা অমান্য তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ সুত্র: চট্টগ্রাম প্রতিদিন
পাঠকের মতামত: