ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

‘আহা! প্রতিদিন যদি মন্ত্রী হাসপাতালে আসতেন’

নিজস্ব প্রতিবেদক, বান্দরবান ::

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় যোগ দিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী আসবেন-তাই রবিবার সকাল ৮টার আগেই কনসালটেন্ট ডাক্তার, মেডিক্যাল অফিসার, নার্স-আয়া এবং সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী হাজির ছিলেন বান্দরবান সদর হাসপাতালে। আর পুরো হাসপাতাল অঙ্গন ছিল ঝকমকে। গাড়ি, মোটরবাইক, ইনডোর-আউটডোরের রোগী সবাই ছিলেন। কিন্তু দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ছিলেন না মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের একজনও। সকাল পৌনে ১০টার দিকে মোটরবাইকে চড়ে হাসপাতাল অঙ্গনে ঢোকে পড়েন একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ। অন্যকোনো রিপ্রেজেন্টেটিভকে দেখতে না পেয়ে তিনি বুঝতে পারেন-কোথাও কিছু একটা ঘটেছে। তাই মোটরবাইকে চেপে এক পাক ঘুরেই তিনি চম্পট দিলেন।

হাসপাতালে মাঝে মাঝে আসেন-এমন একজন বললেন, ‘প্রতিদিন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভরা গেটে দাঁড়িয়ে রোগীদের প্রেসক্রিপশন কেড়ে নিয়ে ডাক্তার সাহেব তাঁদের কম্পানির ওষুধ লিখেছেন কিনা-তা যাচাই করতেন। তারা কেউ না থাকায় আজ হাসপাতালটিকে চেনাই যাচ্ছে না। আহা! প্রতিদিন যদি মন্ত্রী হাসপাতালে আসতেন!’

সকাল সাড়ে ১০টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি, জেলা প্রশাসক দাউদুল ইসলামসহ অতিথিরা এলেন। তাঁরা হাসপাতালের বাহ্যিক পরিবেশ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। পরে হাসপাতাল ভবনের তৃতীয় তলার সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. মাজেদুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রীকে জানান, হাসপাতালে এমন অনেক ভালো ভালো যন্ত্রপাতি আছে। যা সারাদেশের দুয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও নেই। যেমন-‘জিন মেশিন।’ ডা. মাজেদ জানান, এই যন্ত্র সারাদেশে মাত্র দুটি আছে। একটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অন্যটি বান্দরবান সদর হাসপাতালে। এই যন্ত্রে বিনা মূল্যে রোগ নির্ণয় করা যায়। এ পর্যন্ত ৩০২ জন রোগী এই যন্ত্রের সেবা নিয়েছেন।

ডা. মাজেদের তথ্য অনুযায়ী অপারেশন থিয়েটার, ইনকিউবেটরসহ আরো কিছু দুর্লভ যন্ত্রপাতি তাঁরা সরবরাহ পেয়েছেন। এগুলো ব্যবহার করে তাঁরা জনগণকে দারুণ সেবাও দিচ্ছেন! সভায় জানানো হয়, এই হাসপাতালে আছে নারীবান্ধব কর্নার, শিশু কর্নার, ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার, ব্লাড ব্যাংক, দুর্লভ এক্স-রে মেশিন। রোগীরা কোন কক্ষে কোন সেবা পাবেন-এটি জানাতে হাসপাতালে হেল্পডেস্কও আছে ।

তিনি জানান, ৫০ শয্যার বান্দরবান হাসপাতালকে ১০০ শয্যা এবং বর্তমানে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও জনবল বা কোনো সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়নি। এরপরও সীমিত লোকজন নিয়ে তাঁরা চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করে যাচ্ছেন।

ডা. মাজেদের এসব তথ্য শুনে হতবাক হয়ে যান হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নেই-এমন লোকজন। বান্দরবান হাসপাতালের দুর্দশার কথা কে না জানে? কিন্তু ডা. মাজেদের বর্ণিত তথ্যে এটিকে একটি মহান সেবামূলক হাসপাতাল হিসেবে তুলে ধরায় বিস্মিত হন তাঁরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই হাসপাতালে অনুমোদিত ২১টি পদের মধ্যে দায়িত্বরত আছেন মাত্র ৮ জন। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন সিভিল সার্জন নিজে। আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারের (আরএমও) পদ শূন্য দীর্ঘদিন যাবৎ। ডা. মাজেদুর রহমানের মূল কর্মস্থল লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। আরএমওর শূন্য পদে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে ডেপুটেশনে।

জরুরি চিকিৎসার জন্য তিনটি ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারের অনুমোদিত পদের বিপরীতে পদায়িত আছেন মাত্র একজন। কিন্তু তাঁকেও প্রেষণ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এখন ইমার্জেন্সি বিভাগ খাঁ খাঁ করছে। কিছুটা সামাল দিচ্ছেন নার্স ও ব্রাদাররা। মেডিক্যাল অফিসারের চার পদের মধ্যে আছেন দুজন। নেই দন্ত ও চক্ষু চিকিৎসক। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চার পদের মধ্যে দুটি শূন্য। যাঁরা দায়িত্বরত আছেন-তাঁরাও সপ্তাহে দুয়েকদিন বসেন দুপুর সাড়ে ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত। এরপর সবার গন্তব্য জেলার বাইরে, নিজের চেম্বারে। ফলে এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নির্ভর করে হাসপাতালের নার্স-আয়াদের ওপর।

এসব সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন পার্বত্য মন্ত্রী নিজেও। তিনি জানতে চান-ভেতরে এত ঘা রেখে হাসপাতাল কীভাবে জনগণকে এত সেবা দিচ্ছে? তিনি প্রশ্ন তুলেন, যে হাসপাতালে ঢুকতে দুর্গন্ধে নাক চেপে ধরতে হয় সেখানে এত দামি দামি যন্ত্রপাতি রেখে লাভ কী? এ সময় সিভিল সার্জনসহ সবাই নিরুত্তর ভূমিকা পালন করেন।

এ সময় মন্ত্রীর সরকারি দেহরক্ষী এবং উপস্থিত কয়েকজন সভাকক্ষের বাইরে রাখা চেয়ারগুলোর দিকে সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জানা গেল, ধুলোর আস্তরণের কারণে কেউই সেগুলো ব্যবহার করতে পারছেন না।

দুপুর সাড়ে ১২টায় মন্ত্রী, জেলা প্রশাসক এবং অভ্যাগতরা হাসপাতাল ত্যাগ করলে একে একে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন ওষুধ কম্পানির মাঠ প্রতিনিধিরা। হাসপাতাল ফিরে পায় তার প্রতিদিনকার চেনা রূপ।

পাঠকের মতামত: