লামা ও আলীকদমে বিধি বহির্ভূতভাবে পাথর আহরণ ও নদীর তীর কেটে তামাক চাষের বিরুপ প্রভাবে দ্রুত নাব্যতা হারাচ্ছে প্রমত্তা মাতামুহুরী। এ নদীর তলদেশ এখন সবুজ ফসলের মাঠে পরিনত হয়েছে। অস্বাভাবিকভাবে নাব্যতা হারানোর কারনে বর্ষা মৌসুমে সামান্য বর্ষণের ফলে নদীর দু’কুল ফুঁস উঠে সৃষ্ট বন্যায় প্রতিবছর উপজেলা দু’টির ব্যাপক জান মালের ক্ষতি সাধিত হয়। স্থানীয়রা জরুরী ভিত্তিতে এ নদী ড্রেজিংয়ের দাবি জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত ক্রাউডং বা ময়ভার পর্বতমালা থেকে মাতামুহুরী নদী উৎপন্ন হয়ে আলীকদমের রিজার্ভ বনভূমির উপর দিয়ে সর্পিল গতিতে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে লামা উপজেলা পর্যন্ত এসে পশ্চিম দিকে মোড় নিয়ে কক্সবাজরের চকরিয়া উপজেলার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এ নদীর উৎপত্তি স্থান থেকে ৩২৪ কিলোমিটার পথে রয়েছে ১২ টি খাল ও ৫৪ টি ঝিরি। এ নদীটি তার অববাহিকতায় বসবাসকারি জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছিল।
গত কয়েক দশক ধরে স্থানীয়দের লোভ–লালসার ফলে এ নদীর অববাহিকতায় পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটেছে। লামা ও আলীকদমের পাহাড়ের পাদদেশ ও ঝিরি খুড়ে বিধি বর্হিভূত ভাবে পাথর আহরণ অব্যাহত থাকার বিরুপ প্রভাব পড়েছে এ নদীর উপর। নিয়ম বর্হিভূতভাবে পাহাড় কেটে এবং খুঁড়ে পাথর আহরনের ফলে বর্ষা মৌসুমে প্রবল বর্ষনের সময় এসকল পাহাড়ের অংশ বিশেষ ধ্বসে পড়ছে। ধ্বসে পড়া পাহাড়ের বালি ও মাটি বৃষ্টির পানির সাথে মিশে মাতামুহুরী নদীতে গিয়ে পড়ায় এ নদী দ্রুত তার নাব্যতা হারিয়েছে। অপর দিকে, আশির দশকে এতদাঞ্চলে তামাক চাষ শুরুর মধ্য দিয়ে মাতামুহুরী নদীর উপর দ্বিতীয় দফায় বিপর্যয় নেমে আসে। অতি মুনাফার লোভে মাতামুহুরী নদীর দু’কুল কেটে চাষ উপযোগী করে তোলে তামাক চাষ করে স্থানীয় কৃষকেরা। বর্ষা মৌসুমে ওই সকল মাটি মাতামুহুরী নদীতে গিয়ে পড়ে নদীর বাঁকে বাঁকে কচ্ছপের পিঠের মত অসখ্য চর জেগে উঠেছে। অস্বাভাবিকভাবে নাব্যতা হারানোর সুযোগে নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা নদীর তলদেশে বাদামসহ বিভিন্ন মৌসুমী তরি–তরকারির চাষ করেছেন। একসময় যেখানে ছিল গভীর পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বাস। এখন সেখানে পুরো নদীর তলদেশ জুড়ে শোভা পাচ্ছে সবুজ ফসলের মাঠ।
মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া জানান, ১৯৮০–৮৫ সালে মাতামুহুরী নদীর গভীরতা ছিল ৩০ থেকে ৪০ ফুট। কিন্তু গত এক দশকে ব্যাপক হারে পাথর আহরণ এবং নদীর তীর কেটে তামাক চাষের বিরুপ প্রভাবে এ নদী দ্রুত নাব্যতা হারিয়েছে। নদী তীরবর্তী বাসিন্দা মোঃ নবীর উদ্দিন জানান, একসময় চকরিয়াসহ পার্শ্ববর্তী মানিকপুরের ব্যবসায়ীরা মালামাল আনা নেয়ার সুবিধার্থে নদী পথ ব্যবহার করলেও বর্তমানে নদীর পানি কমে যাওয়ায় নৌ চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া এ নদী নাব্যতা হারোনোর কারনে সামান্য বৃষ্টিতে পানি ফুলে উঠে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নদী তীরবর্তী লামা পৌর শহরসহ আলীকদম উপজেলার ব্যাপক জানমালের ক্ষতিসাধন করে থাকে। লামা উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে লামা, আলীকদম ও চকরিয়া উপজেলার দু’সহস্রাধিক জেলে পরিবার। গত কয়েক বছরে ব্যাপকহারে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং কৃষিজ সেচ কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, নাব্যতা কমার কারণে চলতি বর্ষায় প্রবল বৃষ্টির কারণে নদীর পানি ফেঁপে উঠে লামা ও আলীকদম উপজেলার বিতৃর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়। এতে স্থানীয়দের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এ বিষয়ে বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করে সম্ভব হয় নাই। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, যে কোনো নদী ড্রেজিং করার আগে জরিপ করতে হয়। এ নদীটি এখনো জরিপের আওতায় আসেনি।
প্রমত্তা মাতামুহুরীর তলদেশে এখন আর অথৈ পানি নেই। নেই জেলেদের জাল ফেলার সুযোগ। সর্বত্রই জেগে রয়েছে বালির চর। দ্রুত এ নদীর ড্রেজিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন স্থানীয়রা ।
পাঠকের মতামত: