১৭৬ সাইট বন্ধ করে দেওয়ার পরও চলছে ব্যবস্থা নেওয়াটা একটু কঠিন : পুলিশ :
নিউজ ডেস্ক :: জুয়ার আসরে চলমান অভিযানের আড়ালে রমরমা অনলাইনে জুয়া। অনলাইনে ওয়েবসাইট ‘বেট ৩৬৫’ বা ‘বেট এশিয়া ৩৬৫’-এ একাউন্টের মাধ্যমে চলছে এই জুয়ার আসর। কারো হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকলেই খেলা যায়। অনলাইনে টাকার জায়গায় ডলারে এই জুয়া খেলছে অনেকে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নির্দেশে দেশে অনলাইনে জুয়া খেলার ১৭৬টি সাইট বন্ধ করে দেওয়ার পরও বন্ধ হয়নি সর্বস্বান্ত করার এ খেলা। বন্ধ করে দিলেও ভিপিএন, প্রক্সি সার্ভার ও অ্যাপ দিয়ে তা চালানো সম্ভব হচ্ছে। এদের বড় একটা অংশ নিম্ন আয়ের অশিক্ষিত মানুষ। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই ওয়েবসাইটে একাউন্টটি তারা নিজেরা খোলেননি। একটি চক্র রয়েছে যারা টাকার বিনিময়ে এই একাউন্ট খোলা এবং তা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন।
অনলাইনে জুয়ায় জড়িতরা জানান, প্রতিদিন হাজার হাজার ডলার বাজি চলছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ-আফগানিস্তান টি টুয়েন্টি ম্যাচকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরী, এমনকি উপজেলা পর্যায়েও বিভিন্ন এলাকার চায়ের দোকানে ক্রিকেট জুয়াড়িদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। কেউ সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি ওভার বা বলে বাজি ধরছেন আর একটি অংশ তাকিয়ে আছেন মোবাইল ফোনের দিকে। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন সিএমপির নগর গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন। গতকাল তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, এটি আমাদেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। যার হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে সে যেকোনো জায়গায় বসে সফটওয়্যার ডাউনলোড করে এটি খেলতে পারছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা একটু কঠিন। যদি গ্রুপ বেঁধে এ ধরনের খেলা চলে, সংবাদ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
গোয়েন্দা সূত্রমতে, খেলার নেশাকে ছাপিয়ে খেলাধুলা বিষয়ক জুয়ার নেশায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেকে। কেউ সর্বস্বান্ত হতে চলেছেন, কেউ আবার সর্বস্ব হারিয়ে হয়েছেন আত্মহননকারী। এমন পরিস্থিতির পেছনে নীরবে ভূমিকা রেখে চলেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ক্রীড়াবাজির সাইট বেট ৩৬৫ ডটকম। এছাড়া অনলাইনে জুয়া খেলার জনপ্রিয় সাইটগুলোর মধ্যে বেট এশিয়া ৩৬৫, বেটওয়ে ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, ডাফাবেট ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, সাইট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, ইউনিবেট ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, নেটবেট ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, উইনার ডটকম ও পেডি পাওয়ার ডটকম বাংলাদেশে প্রচলিত।
কয়েকজন জুয়াড়ি গণমাধ্যমকে জানান, অনলাইনে জুয়া খেলতে প্রথমে যেকোনো অনুমোদিত ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে হয়। সেই একাউন্টের রেফারেন্সে ক্রেডিট কার্ড নেয়া হয়। এ ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা ট্রান্সফার করতে হয় ডলারের মাধ্যমে। এ অনলাইন জুয়ার একাউন্ট সবার থাকে না। হাতেগোনা কয়েকজনের থাকে। কয়েকজন একাউন্ট হোল্ডারের আবার একাধিক ব্রোকার বা দালাল থাকে। তাদের সহায়তায় অনলাইন জুয়ার একাউন্টধারী ব্যক্তির রেফারেন্সে যাদের একাউন্ট নেই এ রকম হাজার হাজার জুয়াড়ি অনলাইন জুয়ায় অংশ নেয়। দালালরা বাজিকরদের কাছ থেকে বাজি ধরার জন্য নগদ টাকা নিয়ে বাজিতে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়। প্রতিটি খেলায় বাজির উপাত্ত দেওয়া থাকে। তার ওপর ভিত্তি করেই বাজি ধরে থাকে জুয়াড়িরা।
বেট এশিয়া ৩৬৫ খেলে নগরীর স্বনামধন্য একটি স্কুলের দশম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী। সে গণমাধ্যমকে জানায়, বেট এশিয়ায় সর্বনিম্ন ২০ টাকা দিয়েও খেলা যায়। অনেকে ভাগ্য পরীক্ষার জন্য এই ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। কারণ, এই সময়ে ১০০ টাকার বিপক্ষে কয়েক গুণ অর্থাৎ ৫০০, ৬০০ কিংবা অধিক টাকাও পাওয়া যায়। আবার এই একটি খেলায় একসময়ে জয়-পরাজয়ের পাশাপাশি ১৯টি পয়েন্টে বাজি খেলা সম্ভব। যেমন টস, প্রথম বলে রান, প্রথম ওভারে রান, প্রথম ৬ ওভারে রান, কোনো ব্যাটসম্যানের জোড়া-বেজোড়া রান, সর্বাধিক স্কোরার, সর্বাধিক উইকেট প্রাপ্তি, ব্যাটসম্যানের আউটের ধরন ইত্যাদিতে বাজি ধরা সম্ভব।
সামপ্রতিক সময়ের ক্রিকেট ও ফুটবল অঙ্গনে স্পট ফিঙিং আর বাজির দরদাম বহুল আলোচিত দুটি শব্দ। আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের ওপর নজরদারি বাড়ানো কিংবা স্পট ফিঙিং প্রতিরোধে আইসিসি বা ফিফা ইদানীং নানা প্রযুক্তির শরণাপন্ন হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জুয়াড়িরা এই প্রচেষ্টার ফাঁক গলে খেলা নিয়ে জুয়া চলছে গলি থেকে রাজপথ সর্বত্রই। বিশ্বকাপ, আইপিএল, বিপিএল কিংবা ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট যা-ই হোক না কেন, জুয়ার জ্বরে আক্রান্ত গোটা দেশ। বর্তমানে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়েকে নিয়ে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টও বাদ নেই।
কয়েকজন বাজিকরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজির ঘোড়া জোরকদমে ছুটেছে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান ম্যাচে। নগদ বাজির পাশাপাশি চলে মাসব্যাপী বাকি বাজির পসরা। এটাকে অনেকে মাসিক ইনকামের অংশ হিসেবে দেখেন। অনেক সময় বাজির টাকা পরিশোধ করতে কেউ কেউ নিস্ব হয়ে যান। মাসিক বাজির ক্ষেত্রে বাজির দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণ করা হয় মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে। তবে পরিবারের লোকজনের কাছে ধরা পড়ার ভয়ে এক্ষেত্রে বেশ সতর্ক জুয়াড়িরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা দুটি মোবাইল ব্যবহার করেন। বাজির দরটা বেশি হলে মোবাইলে রেকর্ডিং করে রাখা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাজিকর জানান, মাসিক বাজিটা সাধারণত করা হয় দীর্ঘদিনের বাজির পার্টনারের সঙ্গে। তবে এক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা জরুরি। মাসের নির্দিষ্ট একটা তারিখ দেওয়া থাকে। ওইদিনই টাকা পরিশোধ করতে হয়। তবে লেনদেনের পরিমাণ বেশি হলে একটা নির্দিষ্ট অংশ অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাসিক বাজির ক্ষেত্রে তালিকায় যোগ হয় স্পেন, ইতালির বিভিন্ন লীগের ফুটবল ম্যাচগুলো। এক্ষেত্রে র্যাংকিং দেখে বাজির দরটা ঠিক করা হয়।
পাঠকের মতামত: