ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার থেকে ২ নভেম্বর :::
শুধু কক্সবাজারের বাতাসে নয়, বালুতেও উড়ছে হাজার হাজার কোটি টাকার ডলার। রয়েছে এর ব্যাপক সম্ভাবনা। এটি কাজে লাগাতে পারলে মানুষের পায়ের নিচের এই সম্পদ থেকে ২০ হাজার কোটিরও বেশি টাকা উর্পাজন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারে উচিত কালক্ষেপন না করেই পরমাণু শক্তি কমিশনের মাধ্যমে উপযুক্ত কোম্পানিকে খনিজ উত্তোলনের অনুমতি দেয়া।
জানা গেছে, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ সমুদ্র উপকূলে পড়ে থাকা এসব বালুর স্তূপের মধ্যে রয়েছে কালো রঙের খনিজ বালু। আর এতে আছে জিরকন, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গার্নেট, রিউটাইল, লিওকনিক্স, কায়ানাইট, মোনাজাইটসহ ভারী খনিজ পদার্থ। আবার সমুদ্র সৈকতে ঢেউ উঠে ফিরে যাওয়ার সময় ওই ভারী পদার্থগুলো সৈকতের বালুতে পড়ে থাকে। এগুলো বিভিন্ন রঙের হয়। কালো রঙের আধিক্য থাকায় এই খনিজগুলোকে বিজ্ঞানীরা ব্লাক গোল্ড বা কালো সোনা নাম দিয়েছেন। খনিজগুলো যথাযথভাবে আহরণ করতে পারলে, তা দেশের বিভিন্ন শিল্প খাতের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের খনিজ পদার্থগুলো উত্তোলন করে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে, তা দেশের শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তা ছাড়া এ খনিজ পদার্থ বিদেশে রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। প্রতিবেশী ভারত এসব খনিজ চীনসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাংলাদেশেরও সেই সুযোগ আছে।
বালুতে পড়ে থাকা এই ভারী খনিজগুলোর পরিমাণ, আর্থিক মূল্য, প্রায়োগিক ব্যবহারসহ অনুসন্ধান কার্যক্রম এবংউত্তোলন বিশেষজ্ঞরা জানান, সৈকতের বালুতে ভারী খনিজ পদার্থগুলো বাংলাদেশের সম্পদ। তা উত্তোলন না করলে সম্ভাবনাময় সম্পদ বালু হিসেবে পায়ের নিচেই থেকে যাবে।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত বালুতে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন টন ভারী খনিজ পদার্থ মিশ্রিত আছে। এগুলো যথাযথভাবে উত্তোলন ও রিফাইনারি মেশিনের মাধ্যমে আলাদা করলে এসব খনিজের আর্থিক মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা হবে।
জানা গেছে, পরমাণু শক্তি কমিশনের নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ দল এরই মধ্যে সৈকতের খনিজ পদার্থ নিয়ে একাধিকবার অনুসন্ধান করেছে। অনুসন্ধানের পর খনিজগুলোর বর্তমান অবস্থা, সম্ভাব্য ব্যবহার এবং আর্থিক সম্ভাবনা নিয়েও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ব্যুরো অব মিনারেল ডেভেলপমেন্ট (বিএমডি) খনিজসম্পদের ব্যবহার ও উৎপাদন নিয়ে কাজ করেছে। অবশ্য এখন কক্সবাজারে বিএমডির কোনো কার্যক্রম নেই। তা ছাড়া সরকারের অনুমতি নিয়ে শুধু টেকনাফের উপকূলবর্তী সৈকতে প্রিকেম্ব্রিয়ান রকস এবং নিউক্লিয়ার টেকনোলজি নামের দুটি অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি খনিজ বালু অনুসন্ধান করেছে। অনুসন্ধানের পর তারা সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। একই সাথে অস্ট্রেলিয়ার একটি কোম্পানি খনিজ বালু উত্তোলনের জন্যও সরকারের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। তবে সরকার সেই আবেদনে এখনো সাড়া দেয়নি।
এদিকে অপর একটি সূত্র জানান, ভারী খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক সরঞ্জাম বাংলাদেশে নেই। ওই পর্যায়ের বিশেষজ্ঞও নেই। ফলে বিদেশি কোনো কোম্পানিকে প্রাথমিকভাবে স্বল্প পরিসরের জায়গায় খনিজ বালু উত্তোলনের সুযোগ দেয়া উচিত। এতে দেশীয় বিশেষজ্ঞরাও বিভিন্ন বিষয়ে জানতে পারবেন। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি বিদেশ থেকে কিনে পরমাণু শক্তি কমিশন কিংবা দেশীয় কোম্পানি খনিজ বালু উত্তোলন করতে পারবে। খনিজ বালু উত্তোলনের কাজে বাংলাদেশের বিভিন্ন কূপে গ্যাস ও তেল যেভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে বলে তিনি পরামর্শ দেন সূত্রটি।
খনিজ বালু অনুসন্ধানের পর প্রতিবেদন তৈরিতে যুক্ত ছিলেন পরমাণু শক্তি কমিশনের এমন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ জানান, সৈকতের কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, উখিয়া ও টেকনাফের ৭ হাজার ৯৮৬ হেক্টর এলাকাজুড়ে ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ উপাদান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৮ প্রকার খনিজ অতি মূল্যবান। প্রাপ্ত খনিজের মধ্যে জিরকন সবচেয়ে মূল্যবান পদার্থ। এটি পারমাণবিক পাওয়ার প্ল্যান্টে ফুয়েল রডে প্রলেপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া সিরামিক, রঙ শিল্প এবং কৃত্রিম স্বর্ণ তৈরিতে জিরকন ব্যবহৃত হয়। অবশ্য কক্সবাজারের পাইলট প্ল্যান্টে এরই মধ্যে স্বল্প পরিমাণে উৎপাদিত জিরকন দেশীয় সিরামিক শিল্পে সীমিত হারে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে একজন বিশেষজ্ঞ জানান। ব্যাপকহারে উৎপাদন করলে দেশীয় সিরামিক শিল্পের চাহিদা মিটিয়ে তা বিদেশে রফতানি করা সম্ভব বলে জানা গেছে। এ ছাড়া গারনেট-সিরিষ কাগজ তৈরি ও রঙ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। রুটাইল, কাগজ ও রঙ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। ইলমেনাইট, লোহা তৈরিতে রেড অকসাইডের সঙ্গে মেশানো হয়। এতে করে রেডিয়েশন যেতে পারে না। ম্যাগনেটাইট, লোহা তৈরির শিল্প এবং ওয়েলডিং রড ও চুম্বক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া কাচ তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়।
সূত্রমতে, ১৯৬০ সালে পাকিস্তান ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর ও ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে যৌথভাবে জরিপ চালিয়ে কক্সবাজারে সৈকত খনিজ আবিষ্কার করে। ১৯৬৮ সালে গবেষণা করে সৈকতের বালিতে ৮ প্রকারের খনিজ পাওয়া যায়। খনিজ উত্তোলনে তখন অস্ট্রেলিয়ার সরকার আগ্রহ দেখায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান এটমিক এনার্জি কমিশন (পিএমসি)-এর আদলে বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি (বিএমসি) সৈকতে ভারী খনিজের ওপর ভূ-তাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও গবেষণা শুরু করে। এ সময় অস্ট্রেলিয়া সরকারের কারিগরি সহায়তা কাজে লাগানো হয়। ১৯৭৫ সালে সৈকত বালু থেকে খনিজ পৃথক করার জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকারের সাহায্যে কক্সবাজারে একটি পাইলট প্লান্ট স্থাপন করা হয়। ১৯৭৯ সালে মিনারেল প্রসেসিংয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ভূ-তাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজ চলে। কক্সবাজারের বদরমোকাম, শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ, সাবরাং, শিলখালী, ইনানী, কক্সবাজার, মহেশখালী, মাতারবাড়ি, কুতুবদিয়ার সৈকতে গবেষণা করে ১৫টি এবং নিঝুমদ্বীপ ও কুয়াকাটায় আরো ২টিসহ মোট ১৭টি খনিজের স্তূপ পাওয়া যায়। খনিজ বালুর স্তূপগুলো সমুদ্রের বর্তমান তটরেখা থেকে ১-২ মাইল স্থলভাগের অভ্যন্তরে ভূ-পৃষ্টের উপরিভাগে অবস্থিত। স্তূপের দৈর্ঘ্য ৫০০ থেকে ১০০০ হাজার ফুট, প্রস্থ ৫০ থেকে ১০০০ হাজার ফুট এবং পুরুত্ব ৩-১৫ ফুট। প্রাক্কলিত বালুর পরিমাণ হলো ২ দশমিক ৫ কোটি টন। এর মধ্যে ভারী খনিজ বালুর পরিমাণ ৪৩ লাখ টন, মূল্যবান খনিজের পরিমাণ ১৭ দশমিক ৬ লাখ টন, জিরকন ১ লাখ ৫৮ হাজার টন, রুটাইল ৭০ হাজার টন, লিউকক্সিন ৯৭ হাজার টন, কায়ানাইট ৯১ হাজার টন, ইলমেনাইট ১৩ লাখ ২৫ হাজার টন, গারনেট ২ লাখ ২৩ হাজার টন, ম্যাগনেটাইট ৮১ হাজার টন এবং মোনাজাইট ১৭ হাজার টন।
পাঠকের মতামত: