স্মৃতির এ্যালবাম থেকে
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কুলঘেষে বনভূমি আর প্রাকৃতিক সম্পদে ঘেরা এককোটি জনগণ অধ্যুষিত দুর্যোগ প্রবন উপকূলীয় অঞ্চল, সাগরে মিশে আছে উপকুলবাসীর সুখ, দুঃখ, কখনও সাগর মিতালী করে বুক পেতে দেয় সম্পদ আহরণে, আবার কখনো বা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মুহুর্তের মধ্যে কেড়ে নেয় অগণিত লোকের প্রাণ- বিনষ্ট করে বিপুল সম্পদ।
বিধাতার সেই অপরিসীম তান্ডব ও লীলাখেলা, যাহা সারা বিশ্বের মানবজাতীকে দেখিয়ে দিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ভূলার নয় ঐ দৈব্য দানবী-রাক্ষসী-কাল-নাগীনি সেই ভয়াল রাত্রি ২৯শে এপ্রিল, ৯১। ঘূর্ণিঝড় কখন সৃষ্টি হল? কিভাবে আঘাত হান্ল? আজ ২৬ বৎসর পর একটু আলোকপাত করছি।
প্রথমে ২৫শে এপ্রিল সকাল ৯ টায় চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর থেকে ১৪০০ কি.মি দক্ষিণ পশ্চিমে একটি নি¤œচাপের সৃষ্টি হয় এবং আবহাওয়া বিভাগ ১নং সতর্ক সংকেত প্রদান করে। নি¤œচাপটি আরও একটু ঘনীভূত হয়ে সন্ধ্যা ৬ টায় ১৩০০ কি.মি দুরত্বে অবস্থান করছিল। ২৬শে এপ্রিল সন্ধ্যা ৬ টায় নি¤œচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়ে চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে ১২০০ কি.মি দূরত্বে যখন অবস্থান করছিল তখন আবহাওয়া বিভাগ ২নং দুরবর্তী হুসিয়ারী সংকেত প্রচার করে। ঘূর্ণিঝড়টি আরও ঘনীভূত হয়ে ২৭শে এপ্রিল সকাল ৯ ঘটিকার সময় ১১০০ কি.মি এবং ঐ দিন মধ্যরাতে ৯৫০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থান করলে আবহাওয়া বিভাগ ৩নং স্থানীয় সতর্ক সংকেত প্রচার করলেন ঐ দিন দুপুর ১২ ঘটিকার সময় ঘূর্ণিঝড়টি আরো অগ্রসর হয়ে ৮০০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থান করলে আবহাওয়া বিভাগ ৪নং স্থানীয় হুসিয়ারী সংকেত প্রচার করলেন এদিকে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির “ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর” স্বেচ্ছাসেবকেরা ১নং সংকেত প্রচার থেকে তাহাদের প্রস্তুতি ও প্রচার কার্যক্রম শুরু করে দেয়। দেখা যায় ঐদিন ২৮শে এপ্রিল সন্ধ্যা ৬ টায় চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দরের সোজাসুজি দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘূর্ণিঝড়টি আরো ঘনীভূত হয়ে ৭০০ কি.মি দূরত্বে অবস্থান করলে আবহাওয়া বিভাগ ৫ ও ৬নং বিপদ সংকেত প্রচার করার সাথে সাথে সি,পি,পি রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকেরা মাঠে নেমে পড়ে এবং ব্যাপকভাবে বিপদ সংকেত প্রচার করতে শুরু করে ঐদিকে ঘূর্ণিঝড়টি ঐদিন মধ্যরাতে ৬৫০ কি.মি দূরত্বে অবস্থান করছিল এবং প্রবল শক্তি সঞ্চার করছিল ঠিক ২৯শে এপ্রিল সকাল ৬ টায় চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দরের দক্ষিণে ৫৫০ কি.মি দূরত্বে অবস্থান করে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হলে আবহাওয়া বিভাগ ঐ সময় মহাবিপদ সংকেত রেডক্রিসেন্ট সি,পি,পি কার্যালয়ে প্রেরণ না করে সকাল ১০ টায় প্রেরণ করেন এবং ঐদিন সকাল ১১ টার সময় রেডিওতে প্রচার করা হয়। এদিকে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকেরা রেডিও মেগাফোন, সাইরেন হাতে নিয়ে ব্যাপক প্রচার ও মানুষকে নিরাপদ স্থান নেওয়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হারিকেন গতি সম্পন্ন প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়টি ঐদিন সকাল ৯ টায় চট্টগ্রাম হতে ৫০০ কি.মি দূরত্বে এবং কক্সবাজার জেলায় রাত ৮ টায় ৩৫০ কি.মি দূরত্বে অবস্থান করছিল এবং রাত ৮ টার দিকে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস বহিতে শুরু করে। বাতাসের গতিবেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করল এবং রাত ১১ টা থেকে ১২ টা র মধ্যে কক্সবাজার জেলায় তথা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কি ঘটে গেল সেই হৃদয় বিচারক ঘটনা কারও পক্ষে সঠিকভাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কল্পনাতীত ঘটনা এটা মানুষের কাছে কেয়ামত এসে গেছে এটা ধারণা হয়েছিল পরদিন ৩০শে এপ্রিল’৯১ বৃহত্তর চকরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে লাশ আর লাশ। গরু, মহিষ, ছাগল ও মানুষ পৃথক করা কষ্ট সাধ্য ব্যাপার হয়ে গেল। অনেক এলেকার ঘর বাড়ীর চিহ্ন পর্যন্ত রইলনা দেশজুড়ে হা-হা কার পড়ে গেল। যখন ৩০শে এপ্রিল ভোরে চকরিয়া উপজেলার পালাকাটা, বুড়িপুকুর সওদাগর ঘোনা, তারপর ডুলাহাজারা, খুটাখালী পরিদর্শন করে পেকুয়া হয়ে মগনামা গিয়ে পৌঁছলাম তখন কিংকর্তব্য বিমূঢ় এবং মনের মধ্যে একটা উত্তর পেলাম আল্লাহ ইচ্ছা করলে কি না করতে পারে। মানুষের প্রাণহানী, গৃহপালিত পশু, সহায়-সম্পদ এত ক্ষতি কেন? বিবেগের কাছে প্রশ্ন করলে আমাদের ব্যর্থতা কোথায়? তৎকালীন প্রশাসনের কি ভূমিকা ছিল? যখন ২৯শে এপ্রিল’৯১ সকাল ১০ টায় রেডক্রিসেন্ট বেতার মারফৎ মহা বিপদ সংকেত এর সংবাদ পাওয়া গেল তখন তাহা আমরা প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের অবগত করি এবং আমরা সি,পি,পি স্বেচ্ছাসেবকরা প্রচার করতে শুরু করে এবং সাধ্যমত চেষ্টা করে মানুষের জান-মাল রক্ষা করার জন্য কিন্তু দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মহাবিপদ সংকেত, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সম্পর্কিত অনভিজ্ঞতার করনে চট্টগ্রামে বিমান ও জাহাজের ক্ষতি, জাহাজ দ্বারা কর্ণফুলী ব্রীজের ক্ষতি, অর্থাৎ কোটি টাকর সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
৩০শে এপ্রিল/৯১ সকালের হৃদয় বিদারক ঘটনা আর একটি আলোকপাত না করলে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায় ৩০শে এপ্রিল ভোরে নিত্য দিনের মত আর কানে ভেসে আসলনা মোয়াজ্জিনের কন্ঠে সেই সুমধুর আজানের ধ্বনি, শোনা গেলানা, ভোর রাতে মোরগের ডাক, ভোরের আলোতে যেইদিকে চোখ যায় শুধু জল, ভাঙ্গা ঘর বাড়ীর চালা, ভাঙ্গা গাছ পালা আর মানুষ ও গবাদি পশুর মৃত দেহ কি করুণ দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। স্থানীয় জন সাধারণ ও সি,পি,পি রেডক্রিসেন্ট এর স্বেচ্ছাসেবকরা সাধ্যমত গর্তকুড়ে এক এক গর্তে ১০/১২ টা লাশ এক সংগে কবর দেওয়া শুরু করে। অধিকাংশ লাশ মহিলা ও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের। কে কার খোজ করে স্বজন হারানোর ব্যথায় শুধু ক্রন্দন আর ক্রন্দন এর ধ্বনি চারিদিকে থেকে ভেসে আসছে মনে হচ্ছে, কক্সবাজার জেলার উপকূল স্বজন হারানোর ব্যথায় কাঁদছে। কে কাকে শান্তনা দিবে, আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় সেখানে ও কাঁদছে আর বাতাসে শুধু স্বজন হারনোর হৃদয় বিদারক ক্রন্দনের শব্দ।
এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য যে দেখে নাই সে কোন দিন বুঝতে পারবেনা। কারণ যারা বেঁচে আছে, তারাও বোবা হয়ে গেছে। যে দৈবক্রমে বেঁচে গেছে তারা লাশের উপর পা দিয়ে শুধু এগিয়ে চলেছে পানীয় ও খাদ্যের সন্ধ্যানে উপজেলা শহরের দিকে। শুধু এক গ্লাস পানির জন্য প্রাণ হারিয়েছে অনেকেই মনে হয়েছে এটা ও বোধ হয় শহীদে কারবালা। ৩০শে এপ্রিল থেকে প্রতিনিয়ত সি,পি,পি রেডক্রিসেন্ট অফিসার ও বিদেশী ডেলিগেইটদের সাথে বৃহত্তর চকরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল পরিদর্শন করেছি দেখেছি শত শত মানুষের গলিত দেহ পানির জোয়ারে ভাসছে আর ওয়াপদার বাঁধ বা উচু জায়গায় জড়ো হয়ে আছে। মানুষের লাশের সাথে অগণিত গবাদি পশু। লিখতে হয় এই নিদারুন মুহুর্তে দেখেছি কিছু লোককে তাদের মানুষ বললে ভুল হবে। তারা মৃত দেহের শরীর থেকে অলংকার খুলে নিচ্ছে, দেখেছি পানিতে ভেসে আসা অপরের জিনিসপত্র নিয়ে টানাটানি করতে দেখেছি কিছু লোকে বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রোতের সাথে ভেসে আসা জিনিসিপত্র কুক্ষিগত করার ঝগড়া, বিবাদ করিতে, দেখেছি বিভিন্ন মানব দরদী সংগঠন, এন, জি, ও, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্গত এলেকায় পৌঁছানোর জন্য আনা সাহায্য সামগ্রী, টানা হেঁচড়া করে নিয়ে যেতে। এইসব লোকালয়ের দিকে গেলে আজ ও মনে হয় সেই এলেকার বাতাসের মধ্যে এখনও ছেলে হারা মাতার ক্রন্দন, মাতা ও পিতা হারা সন্তানের ক্রন্দন, স্বামী হরা স্ত্রীর ক্রন্দন, পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শিশুকন্যার আর্তনাত শুনা যাচ্ছে। না জানি এই দুঃসহ স্মৃতি আর কতদিন স্বজন হারানোদের জ্বালাতন করবে।
যখন একটু পানির জন্য একটু খাদ্যের জন্য মানুষ হাহাকার তখন যে সকল এন.জি.ও সাহায্যকারী সংস্থা এগিয়ে এসেছিল পানি ও খাদ্য নিয়ে সেই সকল এন.জি.ও সংস্থা তাহারা জীবনের স্বার্থকতা অর্জন করেছে।
স্বার্থকতা অর্জণ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পঁচাগলিত লাশ তারা দাফন করেছে, বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী সুষ্টভাবে বিলি-বন্টন করেছে। স্বার্থকতা অর্জণ করেছে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি তাদের বিপুল পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী দুর্গত এলেকায় ঠিক সময়ে হেলিকপ্টারে পৌঁছয়ে দিয়ে। স্বার্থকতা অর্জন করেছে রাজনৈতিক সংগঠন ও বিত্তবানরা যারা ঐ সময়ে দুর্গতদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
শতাব্দীর রেকর্ডসৃষ্টিকার ভরাবহতম ৯১ ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কোনদিন পূরণ হওয়ার নয়। মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে রেডক্রিসেন্ট ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর স্বেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আত্মদান করেছে ২২ জন নিবেদিত প্রাণ। তৎমধ্যে বৃহত্তর চকরিয়া উপজেলার তিন জন। ঐ সময়ের বৃহত্তর চকরিয়া উপজেলার ক্ষয়ক্ষতির একটা চিত্র তুলে ধরা হল।
পুরুষ, মহিলা, শিশু নিহতের সংখ্যা- ১৬,৭০৫ জন। ক্ষতিগ্রস্থ লোক, ৩,২৬,০৯৭ জন। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার- ৬০,০৫৯টি, ক্ষতিগ্রস্থ ফসল- ২৯,৪২১ একর। ক্ষতিগ্রস্থকালী ঘর সম্পূর্ণ- ৩৯,৫৪৩, আংশিক- ৬,২৬৪, গবাদি পশু- গরু-৪৮,৩৩৩, মহিষ- ৭,২৪৫, ছাগল- ২২,১১১, ভেড়া- ৪,৪৪৯, মৃত হাসমুরগী- ১,৬৭,৫৬৪, ক্ষতিগ্রস্থ নলকূপ- ৮৭৫, ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তা- ৩১৫ কি.মি, ক্ষতিগ্রস্থ বেড়ীবাঁধ- ৯৫৯ কি.মি, ক্ষতিগ্রস্থ কালবার্ড- ১২৬, ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ- ৯,৪৪৫, আংশিক-৮৪, ক্ষতিগ্রস্থ চিংড়ী প্রকল্প- ২০,১৪৪ একর, ক্ষতিগ্রস্থ লবণমাট- ৯,৪৪৫ একর, ক্ষতিগ্রস্থ নৌ-যান, ইঞ্জিনচালিত- ২০০, ক্ষতিগ্রস্থদেশীয় নৌকা- ২২,০০০, চকরিয়া ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি বিপুল এবং ৫৬০ জন স্বেচ্ছাসেবকেরা বাড়ীঘর সম্পূর্ণ বিধস্থ হয়ে যায়।
পুরো দেশেল ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করলে দেখা যায় নিহতের সংখ্যা ১,৩৮,৮৮২ জন, নিখোজ ১,২২৫ জন, আহতের সংখ্যা- ১,৩৯,০৫৪ জন, মৃত গবাদি পশু- ১,০৬,১২৯, ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ বিনষ্ট- ৮১,৯৬০, আংশিক বিনষ্ট- ৮,৮২,৭৫০, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বিনষ্ট- ৩,৮৬৫টি, এছাড়া ব্রিজ, কালভার্ট, বেড়ীবাঁধ, পাকা রাস্তা, বিমান, জাহাজ ইত্যাদি এক কথায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিধ্বস্থ হয়ে গেছে।
পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি ঐ ধরণের ঘূর্ণিঝড় যেন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আর আঘাত না হনে।
মোঃ নুরুল আবচার
উপজেলা টিম লিডার
সি,পি,পি রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, চকরিয়া।
পাঠকের মতামত: