মোঃ ফারুক.পেকুয়া
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা। এক সময় চকরিয়া উপজেলার অধিনে সাংগঠনিক থানা হিসাবে পেকুয়ার সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা হত। এই এলাকাটি উপকূল হওয়ায় উন্নয়নের দিকে যেমন পিছিয়ে ছিলেন তেমনি অবকাঠামোর অবস্থা ছিল খুব নাজুক। দাপ্তরিক কাজে নির্ভর করতে হত চকরিয়া উপজেলার উপর। এছাড়াও পেকুয়ার প্রতিটি গ্রামের অবস্থাও ছিল খুবই সুচনীয়।
এই সাংগঠনিক উপজেলার একটি গ্রামের নাম সিকদার পাড়া। ১৯৬২ সালের ৩০ জুন এই গ্রামেই জন্ম নেন সালাউদ্দিন আহমেদ নামে এক শিশু। পিতা মাওলানা ছাঈদুল হক ও মা আয়েশা হকের আদর স্নেহে বেড়ে উঠা সালাউদ্দিন আহমেদ প্রত্যন্ত গ্রাম সিকদার পাড়া থেকে জন্ম নিয়ে এক সময়ের জাতীয় রাজনীতির কর্ণদার হিসাবে দেশ পরিচালনায় অংশ নেন। হয়ে উঠেন বিএনপি রাজনীতির মুখপাত্র।
চকরিয়ার সাংগঠনিক থানা থেকে পেকুয়াকে উপজেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠা যেমন করেছেন তেমনি করেছেন গ্রামীণ অবকাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কলেজ, মাদ্রাসা ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা বিস্তারে পেকুয়াকে এগিয়ে দেন বহু বছর পর্যন্ত।
পেকুয়াতে উন্নয়ন করার পাশাপাশি কক্সবাজার জেলাকে এ ক্যাটাগরির জেলায় উন্নতি করে ৮ উপজেলায় ব্যাপক উন্নয়ন হয় তাঁর হাত ধরে।
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এ মানুষটির ৩০ জুন ৫৯ তম জন্মদিন। এত ত্যাগ এত শ্রম আর মেধা দিয়ে দেশ পরিচালনা করা এ মানুষটির জন্মদিনের সময় ভারতে নির্বাসিত জীবন পার করলেও দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে অল্প সংখ্যক নেতাকর্মী ফেসবুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিলেও পেকুয়া থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের বিএনপি ও সহযোগি সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ওনার অবদান আর ত্যাগকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের এমন উদাসীনতায় দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝেও ক্ষোভ আর হতাশার কথা প্রচারিত রয়েছে।
শিক্ষা জীবনঃ-
স্থানীয় পর্যায়ে শিশু সালাউদ্দিন আহমেদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কিশোর বয়সে শিলখালী উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯৭৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১৯৭৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৮০ সালে আইন বিভাগে ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি(সম্মান) ও ১৯৮৬ সালে এলএলএম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই সাথে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে পরীক্ষা দিয়ে এডভোকেটশীপ সনদ লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে বিসিএসে অংশ নিয়ে বিসিএস ক্যাডারের (প্রশাসন) হন।
চাকুরী জীবনঃ-
১৯৮৫ সালে ৭ম বিসিএস পরীক্ষায় বিসিএস পরিক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিসিএস (প্রশাসন) চাকুরীতে যোগদান করেন।
বগুড়ায় সহকারী কমিশনার ও জেলা প্রশাসনে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্বপালনকালে ১৯৯১ সালে তিঁনি তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসাবে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে সরকারি চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন।
রাজনীতিঃ-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনেই তিঁনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৬ সালে কক্সবাজার কক্সবাজার জেলা বিএনপির আহবায়ক পরে একটানা দুই বার কাউন্সিলের মাধ্যমে জেলা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্মমহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় বিএনপির মুখপাত্র হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ ঢাকাস্থ উত্তরার একটি বাড়ী থেকে নিঁখোজ হন। তিনি ভারতের মেঘালয়ের সিলং শহরে নির্বাসিত থাকাবস্থায় বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
জনপ্রতিনিধিঃ-
১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে সরকারি চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অষ্টম সংসদ নির্বাচনের পর চারদলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করলে সালাহ উদ্দিন আহমদ ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর মন্ত্রীপরিষদে যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাশাপাশি কক্সবাজার জেলার ইনচার্জ মিনিস্টার হিসাবেও দায়িত্বপালন করেন।
বৈবাহিক ও পারিবারিক জীবনঃ-
১৯৮৮ সালের ২০ অক্টোবর সালাউদ্দিন আহমেদ ঢাকার বাসিন্দা সিকান্দর আহমেদ ও সাবিহা আহমেদের কন্যা হাসিনা আহমেদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হাসিনা আহমদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে বিষয়ে এলএলবি (সম্মান) ও এলএলএম করার পর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে পরীক্ষা দিয়ে এডভোকেটশীপ সনদ লাভ করেন। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর নিয়মিত আইন পেশা থেকে সরে যান। সালাহ উদ্দিন আহমদ ও এডভোকেট হাসিনা আহমদ দম্পতির ২ ছেলে ও ২ মেয়ে সন্তানের জনক ও জননী। তাঁদের বড় সন্তান সাঈদ ইব্রাহিম আহমেদ লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজে ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে এমএসসি করছেন, প্রথম কন্যা ফারমিস আহমেদ ইকরা লন্ডনে স্নাতকোত্তর পড়ালেখা করছেন, দ্বিতীয় কন্যা ফারিবা আহমেদ রায়দা কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসী বিষয়ে স্নাতকে অধ্যায়নরত ও কনিষ্ঠ পুত্র সৈয়দ ইউসুফ আহমেদ কানাডার মেগ্রিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে অনার্সে অধ্যায়নরত।
এডভোকেট হাসিনা আহমদও বিএনপি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির পর পর দু’বারের সদস্য। এরপর চকরিয়া-পেকুয়া (কক্সবাজার-১) আসন থেকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। গত সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী জাফর আলমের সাথে ভোট যুদ্ধে হেরে যান।
কারাগার ও নির্বাসিত জীবনঃ-
ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার কারাভোগ করলেও ওয়ান ইলাভেন সরকার গঠনের পর সালাহ উদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তার করতে চাইলে নিজেই ২০০৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তখন থেকে ২ বছর ২ মাস ওয়ান ইলাভেন সরকারের কারাগারে বন্দী থেকে ২০০৯ সালের ২৯ মার্চ তিনি কারামুক্ত হন।
২০১৫ সালের ১০ মার্চ ঢাকাস্থ উত্তরার একটি বাড়ী থেকে মুখোশধারী একদল লোক সালাহউদ্দিন আহমেদকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। তখন থেকে দীর্ঘ ৬২ দিন অজ্ঞাত স্থানে গুম অর্থাৎ নিখোঁজ থাকার পর একই বছরের ১১ মে সালাহউদ্দিন আহমেদকে সর্বপ্রথম মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং এর গলফ লিংক মাঠে পাওয়া যায়। তাঁকে প্রথমে শিলং মানসিক হাসপাতাল, শিলং সিভিল হাসপাতাল ও শিলং এর বিশেষায়িত হাসপাতাল নিমগ্রিসে ভর্তি করানো হয়। মেঘালয় রাজ্যের পুলিশ ২০১৫ সালের ৩ জুন ভারতে অবৈধ প্রবেশের অভিযোগ এনে বৈদেশিক নাগরিক আইনের ১৪ ধারায় সালাহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে এবং তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে প্রথমে হাসপাতালে চিকিৎসা ও পরে শিলং জেলে পাঠানো হয়। শিলং শহর ছেড়ে না যাওয়ার শর্তে বিজ্ঞ আদালত পরে সালাহ উদ্দিন আহমদকে জামিন প্রদান করেন। তখন থেকে নির্বাসিত অবস্থায় খাসিয়া খ্রীষ্টান অধ্যুষিত এলাকা শিলং শহরে বিন্ঞ্চপুর ‘সানরাইজ গেষ্ট হাউজ’ নামক একটি দোতলা ভাড়া বাড়ীতে তিনি বসবাস করে মামলা পরিচালনা করে আসছেন। মামলা দায়েরের পর মেঘালয়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে সালাহউদ্দিন আহমেদকে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত করে ২০১৫ সালের ২২ জুলাই মামলার চার্জশীট দেয়া হয়। চার্জশীটে সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভিন্ন মামলার গ্রেপ্তারী পরোয়ানা এড়াতে উদ্দ্যেশ্য প্রনোদিতভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায় ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর সালাহউদ্দিন আহমেদকে বেকসুর খালাস প্রদান করে শিলং আদালতের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ডিজি খার সিং রায় ঘোষনা করেন। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের এই রায়ে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকে সালাহ উদ্দিন আহমদকে দ্রুততম সময়ে সমস্ত রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে হস্তান্তর করার জন্য বিচারক নির্দেশ দেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদ আদালতের রায় অনুযায়ী সে দেশের রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দেশে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক তখনি গত ২০১৯ সালের এপ্রিলে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বেকসুর খালাস পাওয়া রায়ের বিরুদ্ধে শিলং জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল করেন। এ আপীল মামলার কারণে সালাহউদ্দিন আহমেদের দেশে আর ফেরা হয়নি। বাংলাদেশে সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ২৭ টি মামলা চলমান রয়েছে।
সালাউদ্দিন আহমেদের পারিবারিক সূত্রের বরাত দিয়ে সাংবাদিক সাফওয়ানুল করিম বলেন, স্যার এখন অসুস্থ। হার্টের সমস্যা, কিডনীর সমস্যা, ডায়াবেটিকসহ কিডনী ও মুত্রতলীতে অপারেশন করেছেন। করোনার কারণে ম্যাডাম শিলংয়ে যেতে না পারায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারছেন না। আপীল মামলাটি কখন নিষ্পত্তি হবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। স্যার দেশে ফিরে আসতে না পেরে ও দেশের মানুষের সুখ দুঃখের ভাগিদার হতে দুঃচিন্তায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ইউসুফ রুবেল ও যুবদল সভাপতি কামরান জাদিদ মুকুটসহ বেশ কয়েকজন দলীয় নেতাকর্মীর সাথে কথা বললে তারা জানান, আমাদের প্রিয় সালাউদ্দিন আহমেদ শুধু কক্সবাজার নয় পুরো দেশের সম্পদ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলী হয়ে তিঁনি নির্বাসিত জীবন পার করছেন। ওনি আমাদের মাঝে বীরের বেশে ফিরে আসবেন। এ জন্য আমরা সকলের কাছে দোয়া কামনা করছি।
পাঠকের মতামত: