অনলাইন ডেস্ক ::
ইয়াবা ডন হিসেবে পরিচিত দেশের শীর্ষ মাদক কারবারি হাজি সাইফুল করিম (৪৫) পুলিশ হেফাজতে যাওয়ার পর ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি তার কারবারিতে জড়িত ৬৭ জনের নাম ফাঁস করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন টেকনাফের আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি, তার তিন ভাই, ভাগিনা ও টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহম্মেদ। ওই তালিকায় পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের কথিত সাংবাদিক ও বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে। এমনকি কক্সবাজার-টেকনাফে বর্তমানে কর্মরত কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নামও তালিকায় আছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত সাইফুল করিমের দেশে আসার তারিখ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ বলছে, গত ৩১ মে রাতে সাইফুলকে আটক করা হয়। তবে এর পাঁচ দিন আগে ২৫ মে রাত ১১টার দিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে ঢাকায় নামার পরই তাকে হেফাজতে নিয়ে নেয় পুলিশ।
এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, শীর্ষ মাদক কারবারি সাইফুল করিমকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। কিছুদিন আগে সাইফুল দেশে আসে বলে আমরা তথ্য পাই। সেই তথ্যের ভিত্তিতে গত ৩১ মে বৃহস্পতিবার রাতে তাকে আটক করা হয়। প্রাথমিকভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অনেক কিছুই বলেছেন।
আমরা তার দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করছি। কক্সবাজারের এসপি আরও বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। সাইফুল করিমের কাছে যাদের নাম পাওয়া গেছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তার কাছ থেকে যারা সুবিধা নিয়েছে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ২৫ মে রাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের (বিজি-০০৬১) একটি ফ্লাইটে ইয়াঙ্গুন থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন সাইফুল। তার বোর্ডিং পাসে লেখা ছিল করিম সাইফুল। রেফারেন্স নাম্বার-৯৯৭২১০৩৫৩১৮০৫ সি১। সাইফুল করিমের আসার খবর আমরা আগেই নিশ্চিত হই। ফ্লাইট থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আমাদের হেফাজতে নিয়ে নিই। একটি সংস্থা চেয়েছিল তাকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যেতে। আমাদের বাধার মুখে তারা নিতে পারেনি। তিনি বলেন, বিমানবন্দর থেকে তাকে আমরা একটি জায়গায় নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল করিম তার জীবনের সব কাহিনীই বলেছেন। তাকে কারা কারা সহায়তা করেছে সেই তথ্যও দিয়েছেন। তার তথ্য পেয়ে আমরা হতবাক। নামি-দামি লোকদের নামও প্রকাশ করেছেন। মূলত ১৬১ ধারায় তার জবানবন্দি নেওয়া হয়। পরে তাকে কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি আরও বলেন, সাইফুল করিমকে হেফাজতে নেওয়ার বিষয়টি আমরা গোপন রাখি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যই তিনি দেশে এসেছিলেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। তিনি বড়মাপের মাদক কারবারি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাইফুল করিমের জবানবন্দিতে সাবেক সাংসদ বদিসহ অন্তত ৬৭ জনের নাম আছে; যারা তাকে সব ধরনের সহায়তা করেছেন। ওই তালিকায় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ কর্মকর্তা ও কতিপয় সাংবাদিকদের নাম রয়েছে। বছর দুয়েক আগে বদির সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দিয়েছিল। এক পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে তা মিটেও যায়। জবানবন্দির তথ্যানুযায়ী, সাবেক সাংসদ বদি, তার ভাই শফিকুল ইসলাম, মৌলভী আবদুর রহমান, আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান, ভাগিনা সাহেদ রহমান নিপু, সাহেদ কামালের সঙ্গে সাইফুল করিমের সম্পর্ক ‘ভালো’ ছিল। কক্সবাজারের এক সাবেক পুলিশ সুপার ও পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের এক সাবেক ডিআইজি তার কারবারিতে জড়িত ছিলেন। জড়িত ছিলেন কক্সবাজার সদরের সাবেক ওসি জসিমউদ্দিন, টেকনাফের সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহম্মেদ, তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি মোহাম্মদ ইসহাক, নুরুল ইসলাম ভুট্ট, টেকনাফের আবদুল গফুর, শামসুল আলম, হ্ণীলার মাহমুদউল্লাহ, মৌলভী রহমান, মৌলভী জহির, হুন্ডি শওকত, মো. শফি, মো. আমিন, আবদুল আমিন, দিদার মিয়া, পৌর কাউন্সিলর নুরুল বশর নুরশাদ, নুরুল হুদা মেম্বার, এনামুল হক মেম্বার, মোয়াজ্জেম হোসেন, ধানু মেম্বার, জামাল মেম্বার, রেজাউল করিম মেম্বার প্রমুখ। এছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের কিছু নেতাও তাকে সহায়তা করেন। কিছু সাংবাদিককে তিনি প্রতি মাসে অর্থ দিতেন। তাদের মধ্যে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের কয়েকজনও রয়েছেন।।এ প্রসঙ্গে কথা বলতে বদির মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে তার স্ত্রী সাংসদ শাহিনা ইসলাম ফোন রিসিভ করেন। অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে এখন আর কথা বলতে চাই না। শুনতেও আর ভালো লাগে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত বছর মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে সাইফুল করিম দুবাই চলে যান। কয়েক মাস পর সেখান থেকে যান মিয়ানমারে। সেখানে তার মামা মোহাম্মদ ইব্রাহিমের কাছে আশ্রয় নেন। মূলত ইব্রাহিমের মাধ্যমেই সাইফুল ইয়াবার চালান নিয়ে আসতেন। এত বড় ইয়াবা ডন হলেও তার বিরুদ্ধে মামলা ছিল অনেক কম। তবে ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মাদক মামলা হয়। ২০১৮ সালে কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ১ হাজার ১৫১ জনের মধ্যে শীর্ষে ওঠে তার নাম। আর ওই তালিকা ধরেই সারা দেশে জোরালো অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর কোনো উপায় না দেখে সাইফুল করিম গা ঢাকা দেন। তিনি আরও বলেন, সাইফুল করিমকে কারা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, কারা তার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন প্রত্যেকের নাম তিনি বলেছেন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা এবং গণমাধ্যমকর্মীও রয়েছেন। আমরা এসব ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে আইনের আওতায় নিয়ে আসব। সাইফুলের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছায় তিনি দেশে ফিরে আসেন। এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেন এক ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তি। এর আগে তার দুই ভাই রাশেদুল করিম ও মাহাবুবুল করিমকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সাইফুল করিমকে আত্মসমর্পণ করাতে তার পরিবারকে চাপ দিয়ে আসছিল পুলিশ। মধ্যস্থতাকারী সাইফুলকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাকে ‘পুলিশের সেফ হোমে’ রাখা হবে। কিন্তু সব পরিকল্পনা ভ-ুল হয়ে যায় সাইফুলের। ধরা দিলেও পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান তিনি। চলতি বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির উপস্থিতিতে প্রথম দফায় ১০২ ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পণের সময় সাইফুল করিমের আত্মসমর্পণের বিষয়টিও জোরালো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু প্রশাসনের সদিচ্ছা না থাকায় আত্মসমর্পণ করেননি আলোচিত এই মাদক কারবারি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাইফুল করিমের এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, মূলত ১৯৯৭-৯৮ সালের মধ্যে তিনি ইয়াবা কারবারে জড়ান। তার উত্থানের পেছনে সাবেক সাংসদ বদিসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ‘বড় মাপের’ নেতাদের হাত ছিল। তার কাছ থেকে ‘মাসোহারা’ নেননি এমন লোক কমই পাওয়া যাবে। সবাই তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। এমনকি এখনকার টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমারের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল। কক্সবাজারের সাবেক ওসি জসিমের সঙ্গে কলাতলিতে তিনি একটি উন্নতমানের হোটেল বানান। তাছাড়া লংবিচ হোটেলের বিপরীতে স্টুডিও নামে একটি হোটেল আছে তার। এরকম অসংখ্য আস্তানা আছে সাইফুল করিমের। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত টাকা নিতেন। শীর্ষ একটি কাগজের এক সাংবাদিককে প্রাইভেট কার পর্যন্ত উপহার দিয়েছিলেন সাইফুল করিম। তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে দেশে আনা হয়। সাইফুল করিম ভালো হয়ে যেতে চেয়েছিলেন। প্রায়ই তিনি বলতেন, ফেরারি জীবন আর ভালো লাগছে না। সূত্র দৈনিক দেশ রূপান্তর
পাঠকের মতামত: