জসিম মাহমুদ, টেকনাফ সংবাদদাতা ::
মিয়ানামরের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর সেদেশের সেনা বাহিনীর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ, হত্যা, জ্বালাও পোড়াও এখনো অব্যাহত রয়েছে। বর্বর নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে রোহিঙ্গারা গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
সারাবিশে^র আনাচে কানাচে যখন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে, যখন মানুষের জীবন উন্নত ও নিরাপদ করতে, নারীর সম্মান রক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে, তখন যে নাফনদী বাংলাদেশ-মিয়ানমারকে দু’ ভাগ করেছে, সেই নাফনদীর ওপারে এভাবেই চলছে বর্বর নির্যাতন। গত এক মাস পার হলেও সেখানে এখনো রোহিঙ্গাদের উপর দমন-পীড়ন চলছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর রাত থেকে যখন বৃষ্টি হচ্ছিল তখন ভিজে ভিজে শাহপরী দ্বীপ জালিয়া পাড়া,জেটি ঘাট,মিস্ত্রী পাড়া,দক্ষিণ পাড়া,ঘোলা পাড়া দিয়ে দলে দলে ডুকছে রোহিঙ্গারা।
স্বামীকে হারিয়ে মাত্র বৃহস্পতিবার নাফনদী পাড়ি দিয়ে প্রাণে বেচেঁ চার সন্তান নিয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে টেকনাফ শাহ পরীর দ্বীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ফাতেমা বেগম (২৮)। সে মিয়ানমার ধংখালী গ্রামের বাসিন্দা। এসময় তার সঙ্গে কথা হয়, তিনি জানালেন, সেনা বাহিনী ও রাখাইনরা মিলে গুলি বর্ষণ, জবাই করে হত্যা, জ্বালাও পোড়াও এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। ‘রোহিঙ্গা অক্কল যতদিন বর্মাত আছে হেটো দিন তুয়ারারে মাইজ্জুম, জান বাচাঁইতো মনে হয়লে এ দেশত্যু জোগুই’ তার কথা অনুবাদ করলে হুবুহু দাড়ায়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্টী যত দিন থাকবে ততদিন নির্যাতন চালানো হবে, প্রাণে বেচেঁ থাকতে চাইলে এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাও। সেনারা এই ভাবে মাইকিং করে যাচ্ছে গ্রামে গ্রামে। তখন কোলে ছিল তার ছোট সন্তান নুর কায়েছ (২)। তার খুব জ্বর তাই মায়ের কোলে ছটফট করতে ছিল। গেল মঙ্গলবার সেনারা রাতে তাদের গ্রামে গুলি বর্ষণ করে আবারো হামলা চালায়। গুলি শব্দ শুনে সে সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে পালিয়ে পাশের প্যারাবনে ঢুকে পড়ে। তখন তার স্বামী ঘরের একটু পূর্বে ধান কেটে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু সেখানে তার রক্ষা হয়নি। তাকে ধরে নিয়ে রাস্তায় জবাই করে হত্যা করে সেনারা। বলার পর একটু চুপ হয়ে থাকেন। তারপর তিনি জানালেন, তারা চলে গেলে ধান কেটে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত তার লাশ। তারা কত যে খারাপ তা বুঝাতে পারবো না। আমার চার সন্তানকে এতিম করে দিয়েছে। আল্লাহ তাদের বিচার করবে। এছাড়া আমাদের মত অভাগিদের আর কি বলা আছে। চার সন্তান নিয়ে আরো ১৫ জন দুঃখিনীদের সঙ্গে এপারে পালিয়ে আসাতে সীমান্তে পৌছি। সেখানেও প্রাণ রক্ষা পাওয়া খুবই কষ্ট। সেনারা এখন জঙ্গল ও প্যারাবনে দিকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ চালাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ভোরে নৌকা করে নাফনদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়া সীমান্ত দিয়ে এপারে অনুপ্রবেশ করি। অনশ্চিত যাত্র, জানিনা কোথায় যাব? এক সঙ্গে পালিয়ে আসা অভাগিরা যেদিকে যায় আমি সেদিকে যেতে যেতে এখানে পৌছি। বৃষ্টির কারনে আর কোথাও যেতে পারছিনা। তাছাড়া গত দুই দিন ধরে শুধু মুড়ি খেয়ে থাকছি এখন খুব ক্ষুধার্থ পেট ব্যথা করছে।
ওই সময় রাস্তার একটু দুরে বৃষ্টিতে দাড়িয়ে ছিল নুর কামাল নামে একটি শিশু। তার বয়স ৭ বছর। তাকে দেখে মনে হলো একটু ভিন্ন, তার চোখে মুখে আতংক ও কান্নার চাপ! হঠাৎ করে দৌড়ে এসে বলল, ‘আরা ঘর যে বর্মাত, মিলিটিরিয়ে আর মা-বাপরে জরগরাই দিয়ে যে’ তার কথায় দাড়া, তার বাড়ি মিয়ানমারে আমার চোখের সামনে মা-বাবাকে জবাই করে হত্যা করেছে সেনা বাহিনঅ। আমি কিছুই করতে পারিনি, কি করবো ছোট মানুষ। তখন শুধু প্রচন্ড কষ্টেয় ছটফট করেছি।’ এক রোহিঙ্গা শিশু এভাবেই বর্ণনা দেন। সে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সে বলে, ‘ আমার বাবা জালাল আহাম্মদ ও মা নুর জাহানকে তারা নৃশংস ভাবে হত্রা করেছে। মানুষ কখনও মানুষকে এমনভাবে মেরে ফেলতে পারে কল্পনাও করতে পারিনি।’ যখন এসব কথা বলছিল, তখন তার শরীর কাঁপছিল। তখন উপস্থিত সবার চোখ ভরে ওঠে জলে। আমরা পাচঁ ভাই-বোন। আমি শুধু এক মাত্র ভাই এবং সবার বড়। এখন বোনদেরকে কোথায় যাব, কি করব? এ কেমন নির্মমতাঙ্ঘ মানুষ কি এমন ববর্রতা চালাতে পারে? এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তবে সব ঘটনা দৃশ্যপটে আসছে না। এটি এখন রাখাইন রাজ্যের নিত্যদিনের ঘটনা।
রোহিঙ্গা পারাপারের নৌকার মাঝি আবদুর রশিদ বলেন, ‘মিয়ানমারে যেসব গ্রামে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে সেখানে আবারো হামলা চালাচ্ছে, যাতে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যায়। বিশেষ করে মংডু এলাকার চমইন্ন্যা, পতেংজা, ধংখালী, মগন্নি পাড়া, হাসসুরাতা, শিলখালী,ভরডেইল,সাইরা পাড়াতে এখনো হত্যা, গুলি বর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াও অব্যাহত রেখেছে। বৃহস্পতিবার ভোরে তার নৌকা করে পতেঙজা পাড়ার ২৫ জন রোহিঙ্গা শাহপরীর দ্বীপ জেটি ঘাট পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। বিনিময়ে যে যা দিয়েছে তা নিয়েছে। অনেকে কিছু দিতে পারেনি। মানবিক চিন্তা করে নিস্পাপ শিশুদের প্রাণ রক্ষা করতে তাদেরকে নৌকায় দিয়ে সহযোগিতা করছি। কারন আমার বাড়িও মিয়ানমারে পতেঙজা। সে জন্য বুঝি সেদেশে সেনারা রোহিঙ্গাদের উপর কি বর্বরতা চালাচ্ছে, যা গন হত্যাকে হার মানাবে। এছাড়া মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া চর, গদুরছড়া ও ধংখালী এলাকার প্রায় ১০ হাজারের মত রোহিঙ্গা এপারে আসার অপেক্ষা রয়েছে। তিনিও নিজের জম্মভুমিতে পরবাসি হয়ে পালিয়ে এসে এখন শাহপরীর দ্বীপ ভাঙ্গা নামক এস্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। ’
এদিকে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক এবং শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত নেত্রী অং সান সুচি গুটা বিশ্বের সঙ্গে মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন টেকনাফের লেদা অনবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা আবদুল মতলব। তিনি বলেন, সুচি তার বক্ত্যবে বলেছিল গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে সেনা অভিযান বন্ধ রাখা হয়েছে, তা পুরাপুরি মিথ্যা। বাস্তবে সেখানে রোহিঙ্গাশূন্য করতে জঙ্গি দমনের নামে সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত অভিযানের নামে জ্বালাও পোড়াও এখনো অব্যাহত রয়েছে। যা এপার থেকেও প্রতিদিন কিছুটা দেখা যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, এ বৃষ্টির দিনেও প্রাণে বাচঁতে প্রাণের ঝুকি নিয়ে নাফনদী পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন নির্যাতিত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বৃষ্টি হওয়াতে ক্যাম্পে ভেতর ও বাহিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপক কষ্ট দেখা দিয়েছে।’
শাহ পরীর দ্বীপ সীমান্তে স্থানীয় বাসিন্দা আবদুস সালাম জানান, গত বুধ বার রাতে শাহপরীর দ্বীপের জেটি ঘাট এলাকায় ওপারে প্রচন্ড গুলি শব্দ শুনা গেছে। সকালে উঠে ভাঙ্গাতে গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ ছিল নারী ও শিশু। তাঁরা ঢুকার সাথে সাথে কেউ কোথায় হারিয়ে যায় এবং এছাড়া গুটি কয়েক পয়েন্ট দিয়ে এপারে প্রবেশ করছে হাজারো রোহিঙ্গা।
মংডুর পতেঙজা থেকে দ্ইু শিশু সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসেছেন নুর নাহার নামে এক নারী। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয়ের খোজেঁ লেদা ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছিল। সে জানায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের পাড়ায় পাড়ায় এখনো হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুরে বাড়িতে ঢুকে তার হাসানকে ধরে নিয়ে যাওয়া সময় বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সন্তানদের নিয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলাম বলে বেঁচেছি। পরে তিনি জানতে পারেন তার ভাইকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই পাড়ায় অন্তত ১০০ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় নুর নাহার।
মংডু মগনিপাড় গ্রামে দেড় হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। তাদের এ অভিযানে সহায়তা করেছে স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন। ওই গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছেন অবস্থাপন্ন জেলে মো. শফি উল্লাহ। তিনি জানালেন, সেখানে এখনো পরিস্থিতি ভয়াবহ। শীলখালীর এক গ্রামেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সহ¯্রাধিক ঘরবাড়ি। েেরাহিঙ্গারা পালিয়েও বাঁচতে পারছে না।
জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন, কিছুদিন স্তিমিত হয়ে আবারও মঙ্গলবার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অনেকটা বেড়েছে। আসলে ওপারে কি হচ্ছে টিক এপার থেকে বুঝা খুব মুশকিল। রোহিঙ্গাদের আগের মত রাস্তার পাশে অবস্থান করতে দেওয়া হচ্ছে না।সবাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
পাঠকের মতামত: