মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, লামা (বান্দরবান) প্রতিনিধি ঃ
বান্দরবানের লামা উপজেলা। উচু-নিচু অসংখ্য পাহাড় নিয়ে সৃষ্টি এই জনপদের। এখানকার মানুষ শত বছর যাবৎ পাহাড়ের চূড়া, পাদদেশ ও কোলঘেঁষে বসবাস করে আসছে। পাহাড়ে গাছ না থাকায় এবং অপরিকল্পিত বসতির কারণে বর্ষা এলেই এই জনপদ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার পাহাড় ধসে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণে এই এলাকার মানুষ বৃষ্টি হলেই ভয়ে থাকে।
লামায় গত তিন দিনে মাঝারি ও বেশীমাত্রার বৃষ্টিপাতে পৌর এলাকাসহ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে পাহাড় ধস শুরু হয়ে গেছে। ইউপি চেয়ারম্যান ও বেসরকারী সংস্থার সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার পরিবার পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে এখনো পাহাড় ধসের কোন প্রাণহানীর খবর আসেনি। বর্ষার শুরুতেই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে উপজেলা প্রশাসন মাইকিং করে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হচ্ছে। পাহাড়ের কোলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী দরিদ্র হওয়ায় বিকল্প কোন সুযোগ না থাকায় এখনো কেউ নিরাপদে সরে যায়নি।
পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্থ লামা পৌরসভার চেয়ারম্যান পাড়ার মোঃ রফিক জানায়, পাহাড় ধসে আমার বসতবাড়ি এখন মাটির নিচে। কিন্তু আমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা না হলে পাহাড় ছাড়তে নারাজ ঝুঁকিতে বসবাসকারীরা। এখনিই পাহাড়ের মৃত্যুঝুঁকিতে বসবাসকারী পরিবার গুলোকে নিরাপদে সরিয়ে না নেয়া হলে আবারো পাহাড় ধসে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
সরকারী জরিপে জেলার সবচেয়ে বেশি পরিবার ঝুঁকিতে রয়েছে লামা উপজেলায়। কিন্তু পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাসরত পরিবারগুলোর কোনো নির্দিষ্ট তালিকা নেই প্রশাসনের কাছে। বেসরকারী হিসেব মতে, লামা পৌরসভা ও লামা সদর, গজালিয়া, রূপসীপাড়া, সরই, আজিজনগর, ফাঁসিয়াখালী, ফাইতং ইউনিয়নে সাড়ে ৫ হাজার পরিবারের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, লামা পৌর এলাকার চেয়ারম্যান পাড়া, নারকাটাঝিরি, হাসপাতাল পাড়া, বড় নুনারবিল পাড়া, চাম্পাতলী, নয়াপাড়া, সাবেক বিলছড়ি, রাজবাড়ী, কলিঙ্গাবিল, কাটাপাহাড়, মধুঝিরি ও ছাগল খাইয়া গ্রামে পাহাড় ধস ঝুঁকিতে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার। উপজেলার আজিজনগর, ফাইতং, রুপসীপাড়া, লামা সদর, গজালিয়া ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকার পাহাড় কেটে অপরিকল্পিতবাবে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করে আসছে পাঁচ হাজারেরও বেশি পরিবার। তবে বেশিরভাগই হতদরিদ্র মানুষ।
উপজেলার ফাসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান জাকের হোসেন মজুমদার, রুপসীপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ছাচিংপ্রু মার্মা ও ফাইতং ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ জালাল উদ্দিন জানিয়েছেন, অতি মূল্যে সমতলের জমি কিনতে পারায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে তারা বসবাস করছে। দফায় দফায় তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও ঝুঁকিপুর্ণ পরিবার গুলোকে নিরাপদ স্থানে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ক্ষতিগ্রস্থ লোকজন জানিয়েছেন, পাহাড় ধস ঘটনার পর তৎসময়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে না।
সূত্র জানায়, ১৯৯৯ সালের পর থেকে লামা উপজেলায় ব্যাপক আকারে পাহাড় ধস শুরু হয়েছে। সে বছর আগস্ট মাসে আজিজনগরে চিউরতলী এলাকায় এক রাতে শতাধিক পাহাড় ধসে পড়ে। সেখানে তিনজন নিহত ও ১২জন আহত হন। ২০০৯ সালে আজিজনগরে তিন পরিবারের ১১জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১২ সালে লামা ফাইতং ইউনিয়নে এক পরিবারের ১১ জন সহ ২৯জন নিহত হন। এ ছাড়া ২০১১ ও ২০১৩ সালে দুজন করে ও ২০১৪ সালে তিনজনের মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাতে বসতঘরে পাহাড় ধসে পড়ে লামা সদর ইউনিয়নের বরিশাল পাড়ায় ৬ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের জুন মাসে লামা পৌর এলাকার হাসপাতাল পাড়া এলাকায় পাহাড় ধসে ৭ জনের মৃত্যু হয়।
বান্দরবানের মৃত্তিকা সংরক্ষণ ও পানি বিভাজিকা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম সাংবাদিককে বলেন, পাহাড়ি পরিবেশে লাগসই বসতি গড়ে না তোলা, নির্বিচারে বন বৃক্ষ কেটে ভূমিতে চাষাবাদ করে মাটি ক্ষয় করা, পাহাড় কাটা, অধিকসংখ্যক বন কেটে জ্বালানি ব্যবহার, পানির উৎস থেকে প্রাকৃতিক পাথর সরিয়ে ফেলার কারণে পাহাড় ধস হচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে পাহাড় ধসের মাত্রা আরও বাড়তে পারে।
পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিংয়ের মাধ্যমে বার বার তাগিদ দেয়া হচ্ছে বলে লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার খিন ওয়ান নু জানিয়েছেন।
এ বিষযে লামা উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’কে জানায়, এখানে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তাদের সবার পক্ষে নিজ উদ্যোগে নিরাপদে সরে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন সহায়তা প্রয়োজন।
পাঠকের মতামত: