আলমগীর হোসেন, কক্সবাজার ::
একদিকে উঁচু পাহাড়, অন্যদিকে সাগরের উত্তাল ঢেউ। মাইলের পর মাইল দীর্ঘ এ দৃশ্য দেখলে যে কারোই চোখ আটকে যায়। এমন অপরূপ দৃশ্য পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই আছে। এ যেন পৃথিবীর স্বর্গ। বলছি পর্যটন অঞ্চল কক্সবাজারের কথা। অথচ, মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে ঠাঁই নেওয়ার পর এখানকার আর্থসামাজিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মহাসম্ভাবনার পর্যটন খাতেও দেখা দিয়েছে মহাধসের শঙ্কা। রোহিঙ্গা ও তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মরণ নেশা ইয়াবার বিস্তারের কারণে কক্সবাজারে পর্যটকরা প্রতিনিয়তই পড়ছেন বিব্রতকর অবস্থায়। ওইসব অপকর্মের কারণে পর্যটকরাও নির্বিঘ্নে -নিশ্চিন্তে অবাধ চলাফেরা করতে পারছেন না। এক ধরনের সন্দেহের নজরে থাকছেন পর্যটকরা।
গত এক সপ্তাহব্যাপী কক্সবাজার অঞ্চল ঘুরে ও বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা যায়, পৃথিবীর দীর্ঘ এ সমুদ্রসৈকতে যথাযথভাবে পর্যটন হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। টেকনাফ-উখিয়ায় রোহিঙ্গারা এসে ইতোমধ্যেই বহু পাহাড় ও সংরক্ষিত বন কেটে উজাড় করে বসতি গড়েছে। প্রতিনিয়তই এ ধারাবাহিকতা চলছে। তা ছাড়াও সমুদ্রসৈকত ও বিভিন্ন পাহাড় এলাকাও বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীরা নানা কৌশলে দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এসব যেন দেখারও কেউ নেই। এমন সম্ভাবনার পর্যটন খাতকে অন্য কোনো স্বার্থেই পর্যটন করপোরেশন অনেকটা অবহেলার চোখেই দেখছে বলে অভিযোগ করেন এখানকার বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করেন, শুধু মেরিন ড্রাইভ ছাড়া এখানে তেমন কিছুই করা হয়নি। বিভিন্ন উন্নয়নের কথা বলা হলেও সেসব কাজের অগ্রগতি অনেক মন্থর। অথচ, শুধু কক্সবাজারের এ পর্যটন খাতকে গুরুত্ব দিয়ে অত্যাধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তুললে পুরো দেশেরই অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে যেতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজারে পর্যটন করপোরেশনের হোটেল-মোটেলগুলোর অধিকাংশ কক্ষ দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করা এনজিওকর্মী ভাড়া নিয়ে আছেন। নামিদামি অন্য ফোরস্টার-ফাইভস্টার হোটেলগুলোও দেশি-বিদেশি এনজিওকর্মীদের ‘দখলে’। মধ্যম বা নিম্নমানের হোটেলগুলো সাধারণ পর্যটকরা ব্যবহার করছেন বেশি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিপুলসংখ্যাক এনজিওকর্মীদের পদচারণার কারণে এখানে খাবার, যানবাহন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে মূল্য বা খরচের মাত্রা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ পর্যটকদের।
‘আমরা কক্সবাজারবাসী’র সমন্বয়ক করিম উল্লাহ কলিম সময়ের আলোকে বলেন, কক্সবাজারে বর্তমানে তিনটি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এগুলো হচ্ছে রোহিঙ্গা, ইয়াবা এবং দখল। তিনি বলেন, প্রভাব খাটিয়ে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা এবং বনাঞ্চল দখল করা হচ্ছে। প্রশাসন যেখানে বাধা দেওয়ার কথা সেখানে প্রশাসনের ব্যানারেও দখল চলছে। পর্যটনের এসব এলাকায় স্থাপনা নির্মাণ থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে উচ্চ আদালতে নির্দেশনা থাকলেও কেউ তা মানছে না। পর্যটন করেপারেশন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
কক্সবাজারের বিশিষ্ট ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ডি এম রুস্তম সময়ের আলোকে বলেন, অনেক দেশেই ছোট বা স্বল্প দীর্ঘ আয়তনের সমুদ্রসৈকতকেও কত সুন্দরভাবে সাজিয়ে পর্যটকদের সামনে উপস্থাপন করে বিপুল অর্থ আয় করা হচ্ছে। অথচ আমাদের কক্সবাজারে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত এবং সাগর তীরেই সারিবদ্ধ উঁচু পাহাড়ের মতো ব্যাপক সম্ভাবনাময় পর্যটনকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে যুগোপযোগী চিন্তা করে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
সরেজমিনে গত সপ্তাহে কক্সবাজার শহর ঘুরে দেখা যায় পুরো শহর জুড়েই খানাখন্দ, ডোবা আর ভাঙা রাস্তা। অপরিকল্পিত পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা। শহরের অভ্যন্তরে শোভাবর্ধন বা আকর্ষণ করার মতো তেমন কিছুই নেই। শহর ঘেঁষে সমুদ্রপাড়ের লাবণী পয়েন্ট, সুগন্ধা ও কলাতলী বিচে গিয়ে দেখা যায় সেখানে পর্যটকদের বসা বা বিশ্রামের জন্য ভাড়াভিত্তিক কিছু শ্লিপিং চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। রাতে সাগরপাড়ের সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্টে কিছুটা আলোর ব্যবস্থা থাকলেও অন্যত্রে সেটিও নেই। রয়েছে দীর্ঘ বালিময় তীর। এমন বালি পেরিয়ে সমুদ্রের পানি স্পর্শ করতে হয় পর্যটকদের। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশসহ অনেক সমুদ্র তীরেই পানির অবস্থানের অনেক কাছে পর্যন্ত পাকা রাস্তাসহ ইট-বালি-সিমেন্টের কার্পেটিং করা রয়েছে।
অপরদিকে কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক হয়ে টেকনাফে যাওয়ার সময় দেখা গেছে, দীর্ঘ ৭৫ কিলোমিটারের এ পথের পুরো অংশই পাহাড় আর সাগরের মেলবন্ধন। এসব এলাকার পাহাড়গুলো আরও বেশি সুন্দর। সমুদ্র তীরের হিমছড়ি ও ইনানী পয়েন্ট ছাড়া অন্যত্রে পর্যটকদের আনাগোনা নেই বললেই চলে। অথচ বলতে গেলে কক্সবাজার শহরকেন্দ্রিক সমুদ্র তীরের চেয়ে টেকনাফের এলাকাগুলো অনেক বেশি মনোরম। কিন্তু এসব এলাকায় পর্যটকদের জন্য কোনো ব্যবস্থায় রাখেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বরং মেরিন ড্রাইভের কয়েকটি পয়েন্টে রোহিঙ্গা ও ইয়াবা কারবারি সন্দেহে সাধারণ পর্যটকরাও হেনস্থার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়তই। আবার পর্যটকের ছদ্মবেশে অনেক সময় মাদকচক্রও তৎপরতা চালাচ্ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও তল্লাশি না চালিয়ে উপায় নেই।
কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা দেখার জন্য কক্সবাজারে ট্যুরিস্ট পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি জেলা পুলিশও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা দেখভাল করছে। তবে রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের পরিবেশ অনেকটা বিনষ্ট হয়েছে। যার প্রভাব পর্যটন খাতেও পড়েছে। আমরা রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
‘সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, কক্সবাজারের এমন সম্ভাবনাকে কাজ লাগাতে না পারাটা দুর্ভাগ্যজনক। এখানকার পর্যটন খাতকে কাজে লাগিয়ে পুরো দেশের অর্থনৈতিক অনেক উন্নয়ন সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিক পদক্ষেপ। সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট অবহেলা রয়েছে। কক্সবাজারের পর্যটন নিয়ে সাধারণ জনগণ ভাবলেও দায়িত্বশীলদের এ নিয়ে তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
কক্সবাজার পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক মোস্তাফিজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, ইতোমধ্যেই কক্সবাজারের সমুদ্রপাড়ের অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়েছে। সমুদ্রসৈকত এলাকা আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত সমুদ্র তীরবর্তী সৈকত সড়ক নির্মাণসহ নানা ধরনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া উন্নত দেশের আদলে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতকে উন্নত করার পরিকল্পনা করছে কর্তৃপক্ষ।
পাঠকের মতামত: