ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

রাখাইনে বর্বরতা দেখলেন ২০ দেশের কূটনীতিক ‘বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে হবে’

অনলাইন ডেস্ক ::roh....

বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনীতিকরা কিছুদিন আগে কক্সবাজারে গিয়ে দেখেছিলেন প্রাণ বাঁচিয়ে বাংলাদেশে ঢোকা কয়েক লাখ রোহিঙ্গার দুর্ভোগের অসহনীয় দৃশ্য। তাঁরা জেনেছিলেন রাখাইনে চলা চরম নিপীড়নেরও খবর।

এবার ওপারে মিয়ানমারে অবস্থানকারী কূটনীতিকরা রাখাইনের কিছু এলাকায় যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার সুবাদে দেখলেন অসহনীয় সব দৃশ্য। বাড়ির পর বাড়ি, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে মিশে আছে মাটির সঙ্গে। আক্রান্ত গ্রামগুলোতে জনমানবের চিহ্ন নেই ধ্বংসস্তূপ ছাড়া। ফিরে এসে ২০ দেশের কূটনীতিকরা যৌথ বিবৃতিতে কড়া বার্তা দিয়েছেন মিয়ানমারকে। বিবৃতির মোদ্দা কথা হচ্ছে :  বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া সবাইকে মিয়ানমারে ফেরত নিতে হবে। সাংবাদিকরা যাতে রাখাইনের প্রকৃত পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখে সবাইকে জানাতে পারেন সে জন্য তাঁদের সব এলাকায় অবাধে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সমস্যার স্থায়ী সমাধানের স্বার্থে বাস্তবায়ন করতে হবে আনান কমিশনের সুপারিশ। পরিদর্শকদলে ছিলেন জাতিসংঘেরও তিন কর্মকর্তা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি। জাতিসংঘও পৃথক বিবৃতিতে বলেছে, মিয়ানমার ছেড়ে যাওয়া সবাইকে তাদের বাড়িঘরে ফিরিয়ে আনতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই—এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে জাতিসংঘ।

২৫ আগস্ট নতুন করে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরুর দিন দশেক পর মিয়ানমার সরকার দেশি-বিদেশি কয়েকটি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে করে নিয়ে রাখাইনের কয়েকটি স্থান ঘুরিয়ে আনে। ওই সফরে সাংবাদিকরা স্বচক্ষে দেখেন, এলাকার একদল সন্ত্রাসী বেপরোয়াভাবে ঘরদোরে আগুন দিচ্ছে। এর এক মাসেরও বেশি সময় পর গত সোমবার বিদেশি কূটনীতিক ও জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের রাখাইনে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো। লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে সেখানে নিধনযজ্ঞ, ধর্ষণ ও জ্বালাপোড়াওয়ের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের কথা জানাচ্ছে, যা বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কোনো সাংবাদিককে মিয়ানমার রাখাইনে ঢুকতে দিচ্ছে না।

সোমবার কূটনীতিকরা রাখাইনের কোথাও কোথাও মিশ্রিত জাতি-সম্প্রদায়ের লোকজনেরও দেখা পেয়েছেন। মিয়ানমার সরকারের দাবি, আরসার হামলার জের ধরেই সহিংসতা শুরু হয়েছিল। বিদেশি কূটনীতিকরা বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা আরসা হামলার নিন্দা জানাচ্ছি এবং এর জের ধরে সহিংসতা ও ব্যাপকসংখ্যক মানুষের বাস্তচ্যুতির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করছি। ’ তাঁদের পরিদর্শনের লক্ষ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত ছিল না উল্লেখ করে কূটনীতিকরা বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘের তদন্ত অনুসন্ধান দলকে রাখাইন পরিদর্শনে যেতে দেওয়ার অনুমতি দাবি করছি। ’

বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা অনেক গ্রাম দেখেছি, পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে কোনো বাসিন্দা নেই। এই সহিংসতা বন্ধ হতে হবে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এমন বাধ্যবাধকতার আওতায়ই দায়িত্ব পালন করে যে তারা কোনো বৈষম্য না দেখিয়ে রাখাইনের সব মানুষকে সুরক্ষা দেবে এবং অংগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলো প্রতিরোধে কাজ করবে। আমরা স্টেট কাউন্সেলরের (সু চি) এসংক্রান্ত বিবৃতিটিকে স্বাগত জানাচ্ছি। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে আচরণবিধি মেনে চলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; তাদের বলা হয়েছে তাদের কারণে কোনো নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু ঘটা চলবে না, তাদেরকে ‘কোল্যাটারাল ডেমেজ’ও এড়িয়ে চলতে হবে। ”

বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া প্রসঙ্গে মিয়ানমারে দায়িত্ব পালনরত এই কূটনীতিকিরা বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী হাজার হাজার মানুষ যাতে স্বেচ্ছায়, মর্যাদার সঙ্গে, নিরাপদে মিয়ানমারে তাদের মূল আবাসস্থলে ফিরতে পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বলছি। ’

কূটনীতিকরা বিবৃতিতে আরো বলেন, ‘রাখাইনের সামনে সম্ভাবনার যেসব সুযোগ রয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমরা মিয়ানমারের বন্ধু হিসেবে তাদের পাশে থাকতে প্রস্তুত রয়েছি। রাখাইন স্টেট কমিশনও (আনান কমিশন) জাতিগত, ধর্মীয় ও নাগরিকত্ব থাকা-না থাকা নির্বিশেষ রাখাইনের সব সম্প্রদায়ের স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সম্ভাবনায় ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অনেকগুলো সুপারিশ করেছে। আমরা কমিশনের প্রতিবেদনের পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই। ’ কূটনীতিকদের সোমবারের সফরটি গণমাধ্যমের অবাধে রাখাইনে দায়িত্ব পালনের সুযোগ বয়ে আনবে বলেও বিবৃতিতে আশা ব্যক্ত করা হয়।

মিয়ানমারে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানির রাষ্ট্রদূত, স্পেনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার, সুইডিশ সেকশন অফিসের প্রধান এবং ব্রিটেন ও ফিনল্যান্ডের ডেপুটি হেড অব মিশন—এই ২০ জনের পক্ষে বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়।

জাতিসংঘও ফিরিয়ে নিতে বলল : রাষ্ট্র আয়োজিত পরিদর্শন দলে জাতিসংঘের তিন কর্মকর্তাও ছিলেন। তাঁরা হলেন মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক লোক দেসালিয়েন, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিনিধি ও ডেপুটি হিউম্যানিটেরিয়ান কো-অর্ডিনেটর ডমেনিকো স্কালপেল্লি এবং ইউএনএইচসিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেসিলে ফ্রাদোত। ফিরে এসে তাঁরা যে অভিজ্ঞতা জানান তার ভিত্তিতে জাতিসংঘ একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়, রাখাইনের বাসিন্দাদের যে চরম দুর্ভোগ তা কল্পনারও অতীত। রাখাইনে আটকে পড়া ব্যক্তিদের জন্য সহায়তা নিয়ে যাওয়ার অনুমতি মিয়ামনমারকে দিতে হবে, যারা পলিয়ে গেছে তাদেরও নিজ নিজ আবাসস্থলে ফিরিয়ে আনতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘ মিয়ানমারের পাশে থাকবে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, সমস্যা সমাধানে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিয়ানমার প্রতিনিধিও পরিদর্শন দলে ছিলেন। ইউনিয়নের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা এমন সব গ্রাম দেখেছি যে পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে; বাসিন্দাদের করা হয়েছে বাস্তুহারা। এই সহিংসতা বন্ধ হতে হবে। ’

জেনেভাতেও নরম সুর : ঢাকার বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে মিয়ানমারের এক মন্ত্রী সম্মত হওয়ার দিনই জেনেভায় দেশটির আরেক মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নাগরিকদের তাঁরা ফিরিয়ে নেবেন। তবে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা চাইলে অনেক কিছুই করতে হবে। সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের নির্বাহী কমিটির সভায় মিয়ানমারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী উইন মিয়াত বলেন, ‘আমাদের পরবর্তী অগ্রাধিকার হচ্ছে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে আনা। ’ তিনি বলেন, মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী এমন ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসন যেকোনো দিন শুরু হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ১৯৯৩ সালের চুক্তি অনুসারে যাচাই-বাছাই করা হবে বলে জানান এই মন্ত্রী। তিনি বলেন, পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলে নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদার পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়ে তাদের গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের কোনো সমস্যা নেই।

এর আগে ইউএনএইচসিআরের প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি মিয়ানমারের মন্ত্রীকে বলেন, তাঁদের উচিত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও অধিকারের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা। ফিলিপ্পো কয়েক দিন আগে নিজে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে গেছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের মুখে রাখাইনে সেনা ও সন্ত্রাসীদের বীভৎস অত্যাচারের বর্ণনা শোনেন। বিভীষিকার মাত্রা ও ব্যাপকতায় স্তম্ভিত ফিলিপ্পো পরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে মিয়ানমারকেই সমস্যার সমাধান করতে হবে।

সু চির দপ্তরের বিবৃতি : সোমবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করার পর ফিরে গেছেন অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী টিন্ট সোয়ে। এরপর গতকাল সু চির দপ্তর থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণার ভিত্তিতেই সেই দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা ব্যক্তিদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে।

এদিকে গতকাল বিবিসির খবরে বলা হয়, সু চি এবার ফ্রিডম অব অক্সফোর্ড স্বীকৃতি হারিয়েছেন। অক্সফোর্ড শহরের নগর কাউন্সিল বলেছে, তারা ১৯৭৭ সালে যে বিবেচনায় সু চিকে এই খেতাব দিয়েছিল, তার আর যোগ্য নন মিয়ানমারের নেত্রী। গত সপ্তাহে অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজ সু চির প্রতিকৃতি নামিয়ে ফেলে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কলেজেই সু চি ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছেন।

পাঠকের মতামত: