ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

মিয়ানমারে গণহত্যা বন্ধে কক্সবাজারে হেফাজতের ৫ দফা দাবী

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পেশ করছেন হেফাজতে ইসলামের কক্সবাজার জেলা সাধারণ সম্পাদক মাওলানা ইয়াছিন হাবিব

cox-hefazat-pic-1_1বিশেষ প্রতিবেদক:
প্রায় দেড় মাস ধরে চলমান মিয়ানমারের আরাকানে নিরীহ মুসলামানদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুঠতরাজ বন্ধে ৫ দফা দাবী দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) সকালে কক্সবাজার শহরের এক আবাসিক হোটেলের সম্মেলন কক্ষে অয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির কক্সবাজার জেলা শাখার পক্ষ থেকে দাবীসমূহ পেশ করা হয়।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্কটমুক্তি ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশ সরকারের জরুরী হস্তক্ষেপ চেয়ে পেশকৃত দাবীগুলো হলো-
১. আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার মাধ্যমে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করা।
২. বাংলাদেশ বিশ্বের ২য় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র ও মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ। তাই আরাকানে মুসলিম গণহত্যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা এবং আরাকানের নির্যাতিত মুসলমানদের জরুরি ভিত্তিতে আশ্রয়দান করা।
৩. রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে তাদের সকল প্রকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও মানবাধিকার সুনিশ্চিত করা।
৪. আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিম সংকট নিরসনে মিয়ানমারসহ বুড্ডিস্ট কান্ট্রিসমূহে বাংলাদেশ থেকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা।
৫. জরুরি ভিত্তিতে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্থ মসজিদ-মাদ্রাসাসহ মুসলিম পরিবার সমূহের পূণর্বাসন এবং আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা প্রদানের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করা।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ কক্সবাজার জেলা সভাপতি মাওলানা আবুল হাসানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা ইয়াছিন হাবিব।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ও উগ্রবাদী মগ দস্যু কর্তৃক আরাকানের নিরীহ মুসলমানদের ওপর ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। তারা মসজিদ-মাদ্রাসা জ্বালিয়ে দেওয়া, লুটতরাজসহ স্মরণকালের ভয়াবহ নির্যাতন, নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। যা জাহেলী যুগের চরম বর্বরতাকেও হার মানায়। এই পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সেখানকার হাজার হাজার শিশুসহ অসংখ্য মুসলিম নারী-পুরুষ তাদের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন ও বসতবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন অবস্থায় অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। মুসলানদের রক্ত স্রোতে ভাসছে আরাকান। সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্র্যয়। আরাকানের মজলুম মুসলমানদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আরাকানে এরকম মুসলিম নিধন ও নির্মম নির্যাতনের কাহিনী অনেক পুরনো। মুসলিম উৎখাতের উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের আরাকানে ১৯৩৭ ইং থেকে ২০১২-১৩ ইং সাল পর্যন্ত ১০০ টিরও অধিক ছোট-বড় আকারের ট্র্যাজেডী সংঘটিত হয়। নানা ঠুনকু অজুহাতে মিয়ানমার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মগ সন্ত্রাসীরা এহেন নরকীয় তা-বের জন্ম দিয়ে হত্যার রাজত্ব কায়েম করে। মুসলমানদের উপর চলমান ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞও তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও উগ্রবাদী মগদস্যুরা মুসলমানদেরকে জবাই করে হত্যা করেছে । মুসলমান হিসেবে পরিচয় পেলেই হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদেরকে হত্যা করে লাশ সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছে। জ্বালিয়ে দিচ্ছে মসজিদ-মাদ্রাসাসহ মুসলমানদের অসংখ্য বাড়ি-ঘর। মুসলিম তরুণীদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করছে।
হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, ধর্ষণ যেন সেখানকার নিত্যনৈমিত্তক ঘটনা। এমন ভয়াবহ বর্বরতায় এ পর্যন্ত শিশু-বৃদ্ধসহ বহু মুসলিম নারী-পুরুষ শাহাদাৎ বরণ করেছেন। মগ বাহিনীর হাতে আহত হয়েছেন হাজার হাজার মুসলিম নাগরিক। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও মগ সন্ত্রাসীরা গুম করেছে অগণিত মুসলমানকে।
সংবাদ সম্মেলনে আক্ষেপের সঙ্গে বলা হয়, আরাকানে এরকম মুসলিম নিধন ও নির্যাতনের ইতিহাস মোটেও নতুন নয়। ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজ বোধাপায়া আরাকান রাজ্য দখল করে মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করে। এরপর ১৯৩৭ সালসহ বিভিন্ন সময়ে লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। নির্যাতনের প্রকটতায় দেশান্তরিত হতে বাধ্য হন বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলমান। বাংলাদেশেও বহু রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এমন বর্বরতার অন্যতম কারণ তারা মিয়ানমার সরকার কর্তৃক সেদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত নয়।
১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার যে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করেছে তাতে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে মিয়ানমার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে তারা আজ সর্বপ্রকার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত শুধু নয়; বরং মানুষ হিসেবেও তাদের কোন মূল্য নেই। জাতিসংঘের মতে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গা মুসলমান। তাদের শিক্ষা, ব্যবসা ও চলাফেরার ওপর সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রাণারোপ করে রাখে। বন্দীদের মতই জীবন যাপন করছে তারা। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আরাকানে অবস্থানরত রোহিঙ্গা মুসলমানরা ঐ অঞ্চলে বন্যার স্রোতে ভেসে আসা কোন জনগোষ্ঠী নয়। তারা জন্মগত ও ঐতিহাসিক ভাবেই আরাকানের নাগরিক এবং তাদের ইতিহাস হাজার বছরের প্রাচীন। অষ্টম শতাব্দী থেকে পর্যায়ক্রমে আরাকানে মুসলিম বসতি গঠিত ও সম্প্রসারিত হয়েছে। ঐ মুসলিম বসতি যাদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল তারা ছিলেন এতদ্ঞ্চলের আদি বাসিন্দা। যারা ইসলামের সুমহান আদর্শে উদ্ভাসিত হয়েছিল। আরাকান অঞ্চলের মুসলমানরা তাদেরই বংশধর। সেজন্য কালিমা ও বিসমিল্লাহ খচিত আরাকান রাজ্যের নিজস্ব নিদর্শন পাওয়া যায়। কবি আলাওলসহ মধ্যযুগের মুসলিম কবি- সাহিত্যিকদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চার প্রাণকেন্দ্রও ছিল আরাকান।
ইতিহাস বলে, ৭৮৮ সনে যখন আরাকান অঞ্চলে মুসলিম বসতি গড়ে উঠে তখন মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবেশই ঘটেনি। এর বহু পরে তিব্বত হয়ে মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্ম প্রবেশ করে। খ্রিষ্ট পূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আরাকান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। অষ্টাদশ শতকে বর্মী রাজ বোধাপায়া সশস্ত্র আক্রমনের মাধ্যমে আরাকানকে বার্মার অর্ন্তভূক্ত করে নিলে দেশটি তার স্বাধীনতা হারায়। তাও মাত্র অর্ধ শতাব্দীর জন্য। তারপরই এই রাজ্য বৃটিশ শাসনে চলে যায়। বৃটিশ শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে এটি আজ মিয়ানমারের অংশ। মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে মিয়ানমার সরকার আরাকানের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন রাজ্য নামে নতুনভাবে নামকরণ করেছে। এভাবে তারা মুসলিম নিধন ও মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আরাকান থেকে মুসলিমদেরকে বহিষ্কারের দাবীও মুসলিম নিধনের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিক স্বীকৃতি প্রদান করে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকারসহ মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমেই এই জুলুম নির্যাতনের অবসান ঘটানো সম্ভব।cox-hefazat-pic-2_1আরাকানে চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গা মুসলমানরা। চলমান সহিংসতায় হাজার হাজার মুসলিম উদ্বাস্তু হয়ে প্রাণ বাচানোর তাগিদে খাদ্য ও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে দিগি¦দিক ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোথাও নিরাপদ আশ্রয় মিলছেনা। নিজ দেশেই চরম নিপীড়িনের শিকার রোহিঙ্গা মুসলমানেরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে নৌপথে প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশে আসার চেষ্ট্রা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। বুক ফাটা কান্না আর মৃত্যুকে মেনে নিয়ে আবার তাদের ফিরে যেতে হচ্ছে মিয়ানমারের দিকে। কোথাও ঠাই না পেয়ে সাগরে ভাসমান অবস্থায় মানবেতর দিনাতিপাত করছে শিশু, বৃদ্ধসহ অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলমান নারী-পুরুষ। সাগরে অনেক রোহিঙ্গা মুসলমানদের সলিল সমাধিও ঘটছে। করুণ এই পরিস্থিতিতে কোন ঈমানদার, বিবেকবান ও মানবিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ নিরব বসে থাকতে পারেন না। আরাকানের মুসলমানদের রক্ষায় তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের ঈমানী ও মানবিক দায়িত্ব।
‘রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে অনুুপ্রবেশ আমাদের কাম্য নয়’ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অরো বলা হয়, বাস্তবতার চেয়ে মানবতা অনেক বড়। তাই আরাকানের মজলুম মুসলমানদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত বাড়ানোও প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের ঈমানী ও মানবিক কর্তব্য।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর জুলুম নির্যাতন থেকে বাঁচতে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা সেসময় আরাকানে আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন। ঐসময় আরাকানের মুসলমানেরা আমাদের শরণার্থীদের আন্তরিকতা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। তাই আমরা দাবী জানাই, প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকার যেন আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথে যৌথ আলোচনার মাধ্যমে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উ™ূ¢ত পরিস্থিতির উত্তরণে আন্তরিক ভূমিকা পালন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মিয়ানমারের আরাকানে চলমান মুসলিম নিধন ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে জাতিসংঘ, ওআইসি, আরব লীগ, আশিয়ানসহ আর্ন্তজাতিক সংস্থা ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব থাকলেও তারা শুধুমাত্র সহিংসতার নিন্দা ও বাংলাদেশের প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দানের আহবান জানিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন বলে দাবী করা হয়। মুসলিম গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক মহল কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি বলে জানানো হয়।
মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুুর এর পরিচালনায় সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন হেফাজতের জেলা সহ-সভাপতি মাওলানা হাফেজ ছালামত উল্লাহ, রামু রাজারকূল আজিজুল উলুম মাদরাসা পরিচালক মাওলানা মুহছেন শরীফ।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন হেফাজতের জেলা সহ-সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা নুরুল আলম আল মামুন, অর্থ সম্পাদক মাওলানা হাফেজ মুবিনুল হক, প্রচার সম্পাদক মাওলানা আবদুস ছালাম কুদছী, জেলা ইমাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা হাফেজ ইউনুছ ফরাজি, হেফাজত নেতা মাওলানা আবদুর রহিম ফারুকী, মাওলানা মনজুরে ইলাহী, মাওলানা সায়েম হোসেন চৌধুরী, মাওলানা নুরুল হক চকোরী, মাওলানা ছাবের আহমদ, মাওলানা খালেদ সাঈফী। সভার শুরুতে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন ক্বারী কলিমুল্লাহ।

পাঠকের মতামত: