নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
সেতুর উপরে মাঝখানে পাটাতন আর নিচে বালুর বস্তার ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার মাতামুহুরী সেতু। এতে যেকোনো মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে কক্সবাজারের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ। ভারী যানবাহন ওঠামাত্রই পুরো সেতুতে কাঁপন শুরু হয়। আতঙ্ক দেখা দেয়, এ বুঝি সেতুটি ধসে পড়ছে! কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই সড়ক ও জনপথ বিভাগের।
সেতুটি অতি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে স্বীকার করলেও সওজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যতদিন সম্ভব হয় ততদিন পর্যন্ত এই সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। তবু বিকল্প সেতুর কাজ শুরু হবে না।
অবশ্য সেতুটি অকার্যকর হওয়ার পর পাশেই নতুন করে একটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এজন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি রয়েছে সওজের।
জানা গেছে, ব্যস্ততম চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাতামুহুরী সেতু দিয়ে যদি যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে বিকল্প সড়ক হিসেবে ব্যবহার করা হবে মহাসড়কের বরইতলী-পেকুয়া-মগনামা সড়ক হয়ে আঞ্চলিক মহাসড়কের পেকুয়া-ঈদমণি এবং চকরিয়ার চৌয়ারফাঁড়ি থেকে চকরিয়া-মহেশখালী সড়কের চকরিয়ার বাটাখালী-চিরিঙ্গা থানা রাস্তার মাথা সড়ক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সওজের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই রুটকে যদি বিকল্প সড়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়
তাহলে ভয়াবহ যানজটের শিকার হবেন যাত্রীসাধারণ। তাছাড়া এই বিকল্প সড়কের জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যয় হবে কয়েকঘন্টা। সময় ব্যয়ের চাইতে বেশি বিড়ম্বনার শিকার হতে হবে বিকল্প এই রুটের তিনটি আঞ্চলিক সড়কের অনেকস্থানে একেবারে সংকুচিত এবং খানাখন্দ থাকায়। আগে থেকে এই তিন সড়কের খানাখন্দ মেরামতসহ যান চলাচল নির্বিঘ্ন করার উদ্যোগ এখন থেকে না নিলে ভবিষ্যতে এর মাশুল গুনতে হবে হাড়ে হাড়ে।
এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় বড়ুয়া জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাতামুহুরী সেতু নানা কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আপাতত কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল চালু রাখা হয়েছে।
এরই মধ্যে যদি কোনো কারণে অকার্যকর হয়ে পড়ে তাহলেই এর পাশে নতুন করে একটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। তবে এখনই এই বেইলি ব্রিজ নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না। সেতুটি সম্পূর্ণ অকার্যকর হলেই বেইলি ব্রিজ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ’
নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় আরো বলেন, ‘যেহেতু চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ব্যস্ততম তাই যানবাহন চলাচলের জন্য বিকল্প হিসেবে বরইতলী-পেকুয়া-মগনামা, পিএবিসি আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং চকরিয়া-মহেশখালী সড়ককে ব্যবহার করা হবে। তবে এসব সড়কের যেখানে সমস্যা রয়েছে তা আগেভাগেই ঠিক করে ফেলা হবে। ’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় পাঁচ বছর আগে ব্যস্ততম চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার মাতামুহুরী সেতুর মাঝখানের একপাশের কিছু অংশে খানাখন্দের সৃষ্টি হলে সেখানে লোহার পাটাতন বসিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে সওজ। এর কিছুদিন না যেতেই অপরাংশে একই সমস্যা দেখা দিলে তাতেও পাটাতন বসিয়ে দেওয়া হয়।
এতে সেতুর মাঝখানের অংশটি অনেকটা উঁচু দেখাচ্ছিল এবং যানবাহন চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছিল। তখন থেকেই এই মাঝ অংশটিকে অনেকে সওজের কবর বলেও আখ্যা দেয়। চট্টগ্রাম এলাকার যানবাহনগুলো এই সেতু দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে তেমন সমস্যার সম্মুখীন না হলেও দূরপাল্লার এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক বোঝাই যানবাহনগুলো বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনায় পড়ে। শুধু ভোররাতে সেতুর এই পাটাতন পার হতে গিয়ে উত্তরবঙ্গের পর্যটক বোঝাই একটি বাস ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এই দুর্ঘটনায় ব্রিজের দক্ষিণাংশের রেলিং ভেঙে সরাসরি বাসটি গিয়ে পড়ে প্রায় ২০ ফুট নিচে নদীর চরে। এতে একসঙ্গে শিশু, নারীসহ অন্তত ২০ জনের প্রাণহানি হয়, আহত হয় আরো অসংখ্য পর্যটক। এর পরেও জরাজীর্ণ এই সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করে আসছে। কিন্তু গেল মে মাসের শুরুতে দ্বিতীয়বারের মতো সেতুটি পতিত হয় আরেক বিপর্যয়ের মুখে। চিরিঙ্গা অংশের একটু আগে জয়েন্টের মধ্যে ধসের সৃষ্টি হলে এর নিচে বালুভর্তি বস্তার ঠেস দিয়ে তার ওপর গাছের গুঁড়ি এবং লোহার এঙ্গেল দিয়ে সেই ধস ঠেকানোর অংশ হিসেবে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। আবার বালুভর্তি বস্তা বিছানোর পর চারদিকে গার্ডারের মতো দেখানে সেখানে ইটের গাঁথুনির প্রাচীরে প্লাস্টার করে দেওয়া হয়। বিশাল এই সেতু বালুর থেরাপি দিয়ে কতদিন টিকিয়ে রাখা যাবে তা নিয়ে সন্দিহান মানুষ।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ চকরিয়া কার্যালয় সূত্র জানায়, যান চলাচলের ক্ষেত্রে ঝুঁকি এড়াতে সেতুর ওপর দিয়ে যাতে ১০ টনের বেশি ওজনবাহী গাড়ি চলাচল করতে না পারে, সে জন্য দুই দিকে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।
চকরিয়া কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবু এহেছান মোহাম্মদ আজিজুল মোস্তফা স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে বলেন, ‘যতটুকু জানি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি একসময় চার লেনের সড়ক এবং মাতামুহুরী নদীর ওপরও চার লেনের ব্রিজ হবে। এ কারণে এখনই নতুন কোনো ব্রিজ নির্মাণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ’
সওজের এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের সেতু মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী এ বছরের জানুয়ারিতে এই সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করার কথা ছিল। মাতামুহুরী সেতুসহ এই মহাসড়কে চার লেনের চারটি সেতু নির্মাণে জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) অর্থ সহায়তা দেবে। তবে এখনো এসব সেতু নির্মাণের কাজ কেন শুরু হচ্ছে না তা বলতে পারেননি তিনি।
জানা গেছে, প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাতামুহুরী সেতুর উপর দিয়ে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।
দিনের বেলায় তেমন সমস্যা না হলেও রাতে দূরপাল্লার বাসগুলো সেতু পার হতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারানো ছাড়াও ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই অতি দ্রুত এই সমস্যা সমাধান করে যান চলাচল ঝুঁকিমুক্ত করতে হবে। নইলে যেকোনো মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সওজ সূত্র জানায়, ১৯৬০ সালে তৎকালীন আরাকান সড়কের চকরিয়ার চিরিঙ্গার মাতামুহুরী নদীর উপর ৩০০ মিটার দীর্ঘ সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় চার বছরে ওই নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার পর এটি যান চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেই থেকে সেতুটির দেখভাল করে আসছিল সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
পাঠকের মতামত: