ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মাতামুহুরী নদী তীর সংরক্ষণ ও পরিকল্পিত খনন কবে ?

নিজস্ব  প্রতিবেদক, চকরিয়া :: পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীকে একসময় বলা হতো মানুষের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু পাহাড় সাবাড়, বারুদ বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন, বৃক্ষ নিধনসহ নানা কারণে বিগত একযুগেরও বেশি সময় ধরে বর্ষা মৌসুমে এই নদী রূদ্রুমূর্তি ধারণ করায় সবকিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবছর একাধিক বন্যায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চকরিয়া-পেকুয়ার মানুষের সর্বনাশ হচ্ছে। একদিনের বৃষ্টিতেই নদীর দুই তীর উপচে ভয়াবহ বন্যায় রূপ নিচ্ছে। নদীর তীর ভাঙনে ভিটে ছাড়া হয়ে আসছে মানুষ। বিলীন হচ্ছে কোটি কোটি টাকার ক্ষেত-খামার। বছর জুড়ে চেষ্টায় মেরামত করা সড়ক মুহূর্তেই ভেঙে খান খান হয়ে আসছে। তাই অভিশাপে পরিণত হয়ে উঠা সেই মাতামুহুরী নদীকে আপন মহিমায় ফেরানোটাই জরুরি হয়ে ওঠেছে। এক্ষেত্রে দীর্ঘসময় ধরে মাতামুহুরী নদীকে যথাযথভাবে শাসন ও সংরক্ষণের জোর দাবি করে আসছিলেন এখানকার মানুষ।

সর্বশেষ মাতামুহুরী নদীর চকরিয়ার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের হাজীপাড়া থেকে চকরিয়া পৌরসভার আবদুল বারিপাড়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৮ সালের মার্চে শুরু হওয়া সেই অপরিকল্পিত ড্রেজিং শেষ হয় ২০২০ সালের জুনে। এতে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয় হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অবশ্য পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদী নিয়ে এবার আশার কথা জানালেন পানি উন্নয়ন বোর্ড।

দপ্তরটির কক্সবাজারের বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী ডক্টর তানজির সাঈফ আহমেদ বলেন, মাতামুহুরী নদীর ভাঙন রোধ করতে দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর দুই তীর সংরক্ষণে জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। এজন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার। অর্থ মিললেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হতে পারে।

মাতামুহুরী নদীর দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণ ও পরিকল্পিত ড্রেজিং (খনন) বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীর পানি নিষ্কাষন ব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে করা হবে। ইতোমধ্যে দেশীয় সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) এর মাধ্যমে নদীর তলদেশ খননের সম্ভাব্যতা যাচাই তথা পিজিবিলিটি স্টাডিও সম্পন্ন করা হয়েছে। দেশীয় সংস্থাটি ইতোমধ্যে প্রকল্প প্রস্তাবনাও তুলে ধরেছে। এটি নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে। এরপর সেই প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হয়।

তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে খনন করে দুই নদীর গভীরতা ফিরিয়ে এনে গতিপথ ঠিক রাখার জন্য এই মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলেই মাতামুহুরী নদী আশীর্বাদে পরিণত হবে।

প্রতিবছর বন্যার তাণ্ডব থেকে রক্ষায় মাতামুহুরী নদীকে যথাযথভাবে শাসন করতে হবে বলে মনে করেন কঙবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম। তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর মাতামুহুরী নদীর ভাঙন রোধে দুই তীর সংরক্ষণ ও নদীর তলদেশের গভীরতা ঠিক রাখাসহ যথাযথভাবে শাসন করার কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি। অতীতে অনেকে এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তারা সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্প গ্রহণ করেননি। যার খেসারত দিতে হয়েছে মানুষকে।

মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি ও প্রবাহ : মাতামুহুরী নদীটি বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার বাংলাদেশ এবং মায়ানমার সীমান্তের পাহাড়ি এলাকা তথা লুসাই পাহাড় (মাইভার পর্বত) হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। উৎপত্তিস্থান হতে উত্তর পশ্চিম দিকে আলীকদম ও লামা উপজেলার মধ্য দিয়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকাভাবে অগ্রসর হয়ে পশ্চিম দিকে কঙবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলা অভিমুখে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে এই নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে চকরিয়া উপজেলায় পড়েছে ৪০ কিলোমিটার।

নদী ভরাটের অন্যতম কারণ : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাকচাষ, পাহাড় সাবাড়, বৃক্ষ নিধন, পাহাড়ে বারুদ বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে বোল্ডার পাথর উত্তোলনসহ নানা কারণে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির সাথে ভরাট হচ্ছে নদীর তলদেশ। এ কারণে নদীর দুই তীর উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বানের পানি।

২০১৫ সালের বন্যায় ক্ষতি ২০০০ কোটি টাকা : ২০১৫ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় শুধু চকরিয়ায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করেছিল উপজেলা প্রশাসন। ৪০ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ চার দফা বন্যায় উপজেলার পাঁচ লাখ মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৫ লাখ মানুষকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে বিশেষ বরাদ্দ দাবি করে ১৩ দফা প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাবনার অন্যতম ছিল মাতামুহুরী নদীর দুই তীর সংরক্ষণ এবং পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং। সেই ১৩ দফা প্রস্তাবনার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি পাঁচবছরেও। এতে ভয়াবহ বন্যায় সবকিছু চুরমার করে দিচ্ছে।

মাতামুহুরী নদী খনন হয়নি একবারও : পার্বত্য বান্দরবানের থানচি সীমান্ত থেকে মাতামুহুরী নদী আলীকদম, লামা, চকরিয়ার কাকারা-কৈয়ারবিল-বেতুয়াবাজার হয়ে পেকুয়ার উজানটিয়া দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। ১৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর জন্ম থেকে কখনো নদীশাসন বা খনন হয়নি। ২০১৫ সালের বন্যায় চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের ১৩ দফা সুপারিশের মধ্যে প্রধান ছিল বান্দরবানের লামার ইয়াংছা থেকে চকরিয়া উপজেলার বাঘগুজারা রাবারড্যাম পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার এবং বেতুয়াবাজার থেকে পালাকাটা রাবারড্যাম পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটারসহ মোট ৪০ কিলোমিটার এলাকায় নদীর খনন এবং উভয় তীরে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ নদীশাসনের। ৩৯ পয়েন্টে নদী ভাঙন ও বেড়িবাঁধ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করে দেওয়া ছিল অন্যতম সুপারিশ।

নদীর প্রস্থতা বেড়েছে, কমেছে গভীরতা : ১৯৮০-৮৫ সালে মাতামুহুরী নদীর গভীরতা ছিল ৩০-৪০ ফুট। প্রস্থ ছিল ৫০০-৭০০ ফুট। কিন্তু নদীর সাথে সংযোগকারী ঝিরি ও খালগুলো থেকে নির্বিচারে পাথর আহরণের কারণে একদিকে যেমন পানির উৎস হারিয়ে গেছে, অপরদিকে ঝিরির পলিতে ভরাট হচ্ছে নদী। গত কয়েক বছরে ভরাট হয়ে নদীর গভীরতা ১৫-২০ ফুটে চলে এসেছে। দুই তীর ভেঙে গিয়ে নদীর প্রস্থতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০০-১২০০ ফুটে। সামান্য বৃষ্টিতে পানি ফুলে-ফেঁপে ওঠে তলিয়ে যায় তীরবর্তী লামা পৌর শহর ও আলীকদম উপজেলা সদর। নদীতে বর্তমানে নৌ-যান চলাচল করছে মাত্র ৩-৪ ফুট পানির মধ্য দিয়ে। কোনো কোনো অংশে আরও কম।

পাঠকের মতামত: