স্টাফ রিপোর্টার, চকরিয়া :
শর্ত ছিল আট বস্তা বালির মধ্যে এক বস্তা সিমেন্ট মিশ্রন করে তা বস্তাভর্তি করে চকরিয়ার প্রপার কাকারার মাতামুহুরী নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজস করে শুধুমাত্র বালির বস্তা ফেলে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কয়েকমাস না যেতেই নগন্য বানের পানিতে তলিয়ে গেছে দেড় কোটি টাকার এই কাজ। এতে বরাবরের মতোই সরকারী টাকার জলাঞ্জলি হলো। এবারের বর্ষা শুরুর আগেই যেনতেনভাবে এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার সময় এলাকাবাসী এতে বাঁধা দিলেও প্রভাবশালী ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের নানা হুমকি-ধমকিতে চুপসে যায় এলাকাবাসী। এ সময় তারা আশঙ্কা করেছিল, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির প্রথম ধাক্কাতেই এই প্রকল্প অকার্যকর হতে পারে। শেষ পর্যন্ত এলাকাবাসীর সেই আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হলো।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই অবস্থায় ঠিকাদার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন প্রকল্পের বিপরীতে সমুদয় বিল উত্তোলন করে নিতে। আর এতে সহায়তা দেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে অধস্তন কর্মকর্তাদেরও যেন তোড়জোড়ের শেষ নেই। এ ব্যাপারে কক্সবাজার-১ আসনের এমপি মোহাম্মদ ইলিয়াছ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসারও আহবান জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
সিমেন্ট ছাড়াই শুধুমাত্র বালির বস্তা ফেলে নির্মিত বাঁধ বন্যার প্রথম ধাক্কায় নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। এই কাজের বিপরীতে সম্পূর্ণ বিল যেহেতু এখনো ঠিকাদার পায়নি, সেহেতু ওই ঠিকাদারকে দিয়ে দরপত্রের শর্তানুযায়ী কাজ বুঝে নিতে সরকারের ঊর্ধতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
প্রপার কাকারার বাসিন্দা জেলা আওয়ামীলীগের প্রবীণ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আনোয়ার হোসেন কন্ট্রাক্টর চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘সিমেন্ট মিশ্রিত নয়, শুধু বালির বস্তাা দিয়েই নদী ভাঙন ঠেকাতে কাজ যখন শুরু করেছিল ঠিকাদার, তখনই আশঙ্কা করেছিলাম সামান্য বৃষ্টিতেই এই বাঁধ ধসে পড়েছিল। আর বন্যার প্রথম ধাক্কাতেই বালির সব বস্তাই গিলে খেয়েছে নদী।
তিনি অভিযোগ করেন, এলাকাবাসীর অনেক আবেদন-নিবেদনের পর মাতামুহুরী নদীর প্রপার কাকারা তীর সংরক্ষণ বাঁধের মেরামতে এভাবে হাজার হাজার বস্তা বিছানো হয়েছে সিমেন্টের ব্যবহার ছাড়াই। এতে নদী ভাঙন ঠোকনো দুরে থাক, সামান্য বৃষ্টিতেই বস্তাগুলো ছিঁড়ে যায়। এতে করে দেড় কোটি টাকার এই প্রকল্প পুরোটাই বন্যায় বিলীন হয়ে গেল।
স্থানীয় আরেক মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘সামান্য বর্ষণের পরই ভাঙন ঠেকানোর জন্য বিছানো বস্তা ফেটে গেলে বিষয়টি টের পাই। সেখানে দেখা যায় কোন সিমেন্ট ছাড়াই শুধু বালি দিয়েই বস্তা বিছিয়ে সরকারের টাকা আত্মসাত করেছেন ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।’
তিনি বলেন, ‘এর আগে মানসম্পন্ন কাজ নিশ্চিতের তাগাদা দিলেও ঠিকাদার শুনেনি। ঠিকাদার ফরিদুল আলম এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও মাঠ কর্মকর্তা নজর¤œল ইসলাম মিলে সরকারের এতগুলো টাকা জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন। এতে কোন অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কি-না খতিয়ে দেখতে হবে।’
জানা গেছে, মাতামুহুরী নদীর প্রপার কাকারা অংশের তীর সংরক্ষণ বাঁধ (সিসি ব্লক) ধ্বসে পড়ে বিগত ২০১৫ সালের জুন মাসে। এর ফলে কাকারার সাথে চকরিয়া উপজেলার চলাচলের একমাত্র সড়কটি ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে বরাদ্দ দিয়ে সিমেন্ট কংক্রিট (সিসি) ব্লকের বদলে সিমেন্ট মিশ্রিত বালি দিয়ে কাজ শুরুর করার ঘোষণা দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু সেই জরুরি মেরামতের কাজ শুরু হয় দশমাস পর। তীর সংরক্ষণ বাঁধে ২০ হাজারের মতো বস্তা ফেলার কাজ বর্ষার আগে দ্রুত শেষ করার জন্য এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অনুরোধ এবং এনিয়ে চকরিয়া নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে টনক নড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারের।
এরইমধ্যে কয়েকদফা বৃষ্টি শুরু হলে বস্তাগুলো ফেটে বালি বের হতে থাকলে নজর কাড়ে এলাকাবাসীর। বিষয়টি ঠিকাদারকে জানানো হলেও তিনি এসবের ধার ধারেননি। পরে ছবিসহ এই প্রতিবেদন দেখে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান নড়েচড়ে বসেন। মাঠ কর্মকর্তা নজর¤œল ইসলামকে (এস.ও) দ্রুত বিষয়টি যাচাইয়ের নির্দেশনা দেন।
ওই সময় পরিদর্শন করে মাঠ কর্মকর্তা নজর¤œল ইসলাম নানা যুক্তি দেখান এলাকাবাসীকে। এ সময় তিনি চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘বালির সাথে সিমেন্ট মিশ্রন হচ্ছে যথাক্রমে ৮ঃ১। ফলে বস্তায় সিমেন্ট দেখা যাচ্ছে না। আর বেশিদিন না হওয়ায় সিমেন্টগুলো জমাট বাঁধেনি। তিনি উল্টো যুক্তি দেন, বাসাবাড়ীর নির্মাণকাজে সিমেন্ট বেশি থাকায় সেগুলো দ্রুত জমাট বাঁধে। এই কারণে বস্তাগুলো জমাট বাঁধতে দেরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই বস্তাগুলো বিছানো হয়েছে প্রায় দেড়মাস আগে। সামান্য সিমেন্টের মিশ্রন থাকলেও সেগুলো নিশ্চিতভাবেই জমাট বাঁধতো। আর এই কদিনেই সেগুলো ছিঁড়ে যেতো না।
সিমেন্ট ছাড়াই শুধুমাত্র বালি দিয়ে এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চকরিয়া ডেভলপমেন্ট সোসাইটির সত্ত্বাধিকারী লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের বাসিন্দা ফরিদুল আলমের বক্তব্য নেওয়ার জন্য অসংখ্যবার যোগাযোগ করা হয় মুঠোফোনে। কিন্তু তিনি কোন সাড়া না দেওয়ায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের বালির বাঁধ বন্যার প্রথম ধাক্কায় বিলিন হওয়ার খবর পেয়ে তা পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় এমপি মোহাম্মদ ইলিয়াছ, চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম, কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত ওসমান।
চেয়ারম্যান শওকত ওসমান চকরিয়া নিউজকে জানান, এলাকাবাসী প্রপার কাকারার মাতামুহুরী নদীর তীর সংরক্ষণ করা নিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছেন। শেষপর্যন্ত সরকার সাড়া দিলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে যেনতেনভাবে সম্পন্ন করা এই প্রকল্প অকার্যকর হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখনো যেহেতু ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়নি, সেহেতু দরপত্রের শর্তানুযায়ী কাজ বুঝে নিতে হবে ঠিকাদারের কাছ থেকে। না হয় বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচী দিয়ে মাঠে নামবেন এলাকাবাসী।’
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান শনিবার রাতে চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘আমি জেনেছি, বন্যার প্রথম ধাক্কায় সেই বাঁধ বিলিন হয়ে গেছে। বাঁধ নির্মাণের শর্ত যথাযথভাবে অনুসরণ করা না হলে ঠিকাদারকে এর দায়ভার নিতে হবে।’
বিল পরিশোধ করা নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘দেড় কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজের বিপরীতে মাত্র দশ শতাংশ বিল ছাড় করা হয়েছে। বিলের বাকী টাকা এখনো পরিশোধ করা হয়নি। কাজ পুরোপুরি বুঝে নেওয়ার পর সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করা হবে, তার আগে নয়।’
উল্লেখ্য, বিগত ১৯৯৭-৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক মাতামুহুরী নদীর গতিপথ পরিবর্তন ঠেকিয়ে ভাঙন রোধকল্পে কাকারা মেনিবাজার স্থান থেকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। এরপর থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মেনিবাজার থেকে প্রপার কাকারায় প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ সিসি ব্লক বসিয়ে এই বাঁধ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ কোটি টাকা। বাঁধটি পর্যায়ক্রমে চিরিঙ্গা মাতামুহুরী সেতু পর্যন্ত নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এরপর থেকে বাঁধ নির্মান কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলায় চলতি বছর থেকে পরবর্তী তিনবছরে ২৫৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এতে ৬০ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষা বাঁধ মেরামত, ১৬ কিলোমিটার প্রতিরোধ বাঁধ নির্মাণ করা হবে। সেই প্রকল্পে মাতামুহুরীর প্রপার কাকারার এই অংশটিও যুক্ত করার দাবি এলাকাবাসীর।
প্রকাশ:
২০১৬-০৭-১১ ০৯:৪৩:১২
আপডেট:২০১৬-০৭-১১ ০৯:৪৩:১২
- মেরিন ড্রাইভ সড়কে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক নিহত
- চকরিয়ায় সাবেক এমপি জাফর সাঈদি সহ আওয়ামী লীগের ২৮৭ জনের বিরুদ্ধে থানায় নতুন মামলা
- চকরিয়ায় যাত্রীবাহী বাস থেকে ৪০ কেজি গাঁজা উদ্ধার, বিক্রেতা গ্রেফতার
- দুর্নীতির আখড়ায় কক্সবাজার সিটি কলেজ
- চকরিয়ায় ব্যবসায়ীকে ডেকে নিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা ছিনতাই
- বদরখালী সমিতির ১১টি মৎস্য প্রকল্পের নিলাম নিয়ে বিরোধ
- রামুতে আপন ভাতিজিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি
- রামুতে ল্যাপটপ পেলেন ৮০ নারী ফ্রিল্যান্সার
- চকরিয়ায় আওয়ামিললীগ ক্যাডার নজরুল সিণ্ডিকেটের দখলে ৩০ একর বনভুমি:
- চকরিয়ায় শিক্ষা ক্যাডার মনিরুল আলমকে ঘুষের বদলেগণপিটুনি
- চকরিয়ার বিষফোঁড়া সিএনজি-টমটম স্টেশন
- চকরিয়া সদরের বক্স রোড সম্প্রসারণ কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ
- বহিরাগতদের নিয়ে কলেজে গেলেন পদত্যাগ করা বিতর্কিত অধ্যক্ষ মুজিবুল আলম
- চকরয়ার ঠিকাদার মিজান গ্রেফতার, কোটি টাকার ঋণের জেল-জরিমানার দায়ে
- কক্সবাজার আবাসিক হোটেলে ৭০ ইউপি সদস্যের ‘গোপন বৈঠক’, আটক ১৯
- চকরিয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, ২টি ডাম্পার ও স্কেভেটর জব্দ
- চকরিয়ার রশিদ আহমদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় : কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে
- ঈদগাঁও’র নবাগত ইউএনও বিমল চাকমা
- চকরিয়ার সাবেক এমপি জাফর আলম, সালাহউদ্দিনসহ আওয়ামী লীগের ৭৩৬ জন আসামী
- চকরিয়ায় ব্যবসায়ীকে ডেকে নিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা ছিনতাই
- উত্তপ্ত রামু সরকারি কলেজ: অধ্যক্ষ মুজিবের অপসারনের দাবিতে কার্যালয় ও প্রশাসনিক ভবনে তালা
- কুতুবদিয়ায় গর্তে ১০ লক্ষ মণ পুরাতন লবন,লোকসানের শংকা চাষীরা
পাঠকের মতামত: