ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

পাউবোর কর্মকর্তাদের যোগসাজসে

মাতামুহুরী নদীর তীর প্রতিরক্ষা কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়ায় ভাঙ্গন রোধে মাতামুহুরী নদীর ডান তীর প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়নে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কাজের মান নিয়ে দুই কিলোমিটারের বেশি এ প্রকল্পের উপকারভোগী দুই ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দারা বারবার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তা আমলে নেননি।

এতে ঠিকাদার যেনতেনভাবে প্রকল্প কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্প তদারকিতেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা প্রকৌশলীদের খুব একটা দেখা যায়নি বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।

পাউবো সূত্রে জানা যায়, চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ও কৈয়ারবিল ইউনিয়নে দুই কিলোমিটার এলাকায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে মাতামুহুরি নদী ভাঙন দেখা দেয়। এতে কয়েক বছর ধরে এখানকার ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয়, বাজার ও ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে দুই ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী কয়েকটি গ্রামের স্থানীয় লোকজন মাতামুুহুরী নদীর তীর সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২৩ জুন ২ দশমিক ২০ কিলোমিটার (২২০০ মিটার) তীর প্রতিরক্ষা কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চারটি প্যাকেজে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ছোয়ালিয়া পাড়ার ৫০০ মিটার কাজের ঠিকাদার ফরিদুল আলমের চকরিয়া ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি।  এ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠান আরও দুইজন ঠিকাদারের পাওয়া কাজ কিনে নিয়ে বাস্তবায়ন করছেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঠিকাদার স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। সংসদ সদস্য জাফর আলমের আত্মীয় পরিচয়ে ফরিদুল আলম কাউকে পাত্তা দেন না। কেউ প্রতিবাদ করলে চাঁদাবাজি মামলা দেওয়া ও কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী অন্যত্র থেকে বালি এনে কাজ বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নদীর তীরে শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করে জিও ব্যাগ ভর্তি করছে। নদীর পলিযুক্ত বালুও জিও ব্যাগ ভর্তি করা হচ্ছে। এতে বর্ষায় ঢলের পানিতে জিও ব্যাগের পলি মাটি গলে খালি হয়ে স্রোতে ভেসে যাবে।

সরজমিন দেখা গেছে, কাজের নকশা অনুযায়ী জিও ব্যাগ বসানোর আগে নদীর তীরে স্লোপ করে চার ইঞ্চি বালি ফিলিংয়ের উপর জিও টেক্সটাইল বিছিয়ে চার ইঞ্চি ইটের খোয়া ফেলে কম্প্যাকশন ধরা আছে। কিন্তু ঠিকাদার কোনো ধরনের বালি ফিলিং করেনি। জিও টেক্সটাইল ও ইটের খোয়াও খুবই নিম্নমানের। তারপরও কোথাও চার ইঞ্চি খোয়া ফেলানো হয়নি।

জিওব্যাগে এক বস্তা সিমেন্টে ১০ টুকরি বালি দেওয়ার কথা থাকলেও ১৮ থেকে ২০ টুকরি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয় বাসিন্দা কবির আহমদ(৭০)। তিনি বলেন, ভিটে-জমি হারিয়ে এলাকার লোকজন সর্বশান্ত। আশা করেছিলাম টেকসই কাজ হবে। কিন্তু ঠিকাদারের কাজ দেখে আমরা হতাশ।

নদীর প্রতিরক্ষা প্রকল্পটির ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী। জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান অনিয়মের সুযোগ পেয়েছে।

কৈয়ারবিল ইউনিয়নের (ইউপি) সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ফরিদুল আলম স্থানীয় ব্যক্তি ও প্রভাবশালী। এ কারণে পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় কাজের অনিয়ম থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নদী থেকে বালু তুলে জিও ব্যাগ ভর্তি করা হয়েছে। খুবই নিম্নমানের কংক্রিট ও সিমেন্ট কম দিয়ে জিও ব্যাগ ভর্তি করেই কাজ করেছেন।’

কাজের তদারকি না করার বিষয় ও অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে পাউবোর বান্দরবান পওর বিভাগের প্রকল্পের শাখা কর্মকর্তা(এসও) নিকু চাকমা নিজেও এ প্রকল্প নিয়ে বিরক্ত বলে জানান। তিনি বলেন, এ প্রকল্পে আমি অতিরিক্ত দায়িত্বে আছি। সাইডে দুই-তিনবার যাওয়া হয়েছে। প্রকল্পের অনিয়মের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, এ নিয়ে আমি বিস্তারিত বলতে পারবনা।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চকরিয়া ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির স্বত্বাধিকারী ফরিদুল আলম দুর্নীতি-অনিয়ম অকপটে স্বীকার করে বলেন,’ মিলেমিশে খাওয়ার জন্যেই কাজ করছি। এ নিয়ে লেখার কী আছে? লিখে কিছুই হবে না।

যোগাযোগ করা হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবান পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অরূপ চক্রবর্তী বলেন, কাজের মান ভালো আছে। তদারকিও ঠিকভাবে হচ্ছে। নকশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

পাঠকের মতামত: