বরইতলী ইউনিয়নের সড়ক গুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পহরচাঁদার লোকজন নৌকা দিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে।
এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া ::
কক্সবাজারের চকরিয়ায় টানা তিনদিনের ভারী বর্ষণে মাতামুহুরী নদীতে নেমেছে উজানের পাহাড়ি ঢলের পানি। বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে পড়ার কারণে উপজেলার গ্রামীণ লোকালয়ের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে বন্যার আংশকা দেখা দিয়েছে।
অপরদিকে উপজেলার আভ্যন্তরিণ বেশিরভাগ ছড়াখাল ও শাখা নদী অত্যধিক ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টি ও ঢলের পানি ভাটির দিকে নামতে পারছেনা। এই অবস্থার ফলে চকরিয়া পৌরসভাসহ উপজেলার একাধিক কয়েকটি ইউনিয়নের অন্তত ৪৫টি গ্রামে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। পাশাপাশি বেশিরভাগ ইউনিয়নের গ্রামীন রাস্তাগুলো পানি নিচে তলিয়ে থাকায় যোগাযোগে বিপর্যয় নেমে এসেছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া লাগাতার ভারী বর্ষণ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত থাকার ফলে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকা গুলোতে পাহাড় ধ্বসের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে পাহাড় ধ্বসের চরম ঝুঁিকতে পড়েছেন প্রায় ২০ হাজার পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে চকরিয়া পৌরসভা, উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বরইতলী, চিরিংগা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। এসব ইউনিয়নের গ্রামীণ সড়কও পানির নিচে রয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
এদিকে বুধবার মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদ সীমা অতিক্রম করলেও বৃহস্পতিবার বিকালের দিকে বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থানে প্রবাহিত হচ্ছে নদীর পানি। তবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যার আশংকা করছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বরইতলী, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল ইউপি চেয়ারম্যানরা জানান, আমাদের ইউনিয়নগুলো মাতামুহুরী নদী সংলগ্ন। নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে অধিকাংশ গ্রামে ঢলের পানি প্রবেশ করায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা-ঘাটসহ অধিকাংশ বসতঘরে পানি উঠেছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দাবি করেছেন, প্রতিবছর বর্ষাকালে ভারী বর্ষণে মাতামুহুরী নদীতে পাহাড়ি ঢল নামে। ওইসময় উপজেলার বেশিরভাগ নিম্মাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেলেও একদিনের মধ্যে নীচের দিকে নেমে সাগরে মিলিত হয়ে যায় পানি প্রবাহ। তাতে জনগনের দুর্ভোগের মাত্রা অনেকাংশে কমে যায়। তবে এবছর জনগনের জন্য বিষপোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে বাস্তবায়িত দোহাজারি-কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত চকরিয়া অংশের রেল লাইনের উঁচু রাস্তাটি।
কারণ ভারী বর্ষণের শুরুতে এই রাস্তার পূর্বাংশজুড়ে আটকা পড়েছে কয়েকফুট উচ্চতায় বৃষ্টির পানি। পানি নেমে যাওয়ার জন্য এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট কালভার্ট না থাকায় এই পানি ভাটির দিকে নামতে পারছে না। পানিতে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির রোপিত ফসল। এক্ষেত্রে রেল লাইনের উুঁচ রাস্তাকেই প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন ভুক্তভোগী মানুষগুলো। অপরদিকে আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিত হতে চলেছেন এখানকার কৃষকেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্ষণের শুরুতে মাতামুহুরী নদীর তীরের জনপদ সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, সাহারবিল, চিরিংগা, কৈয়ারবিল ইউনিয়ন এবং চকরিয়া পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের নিন্মাঞ্চল হাটু সমান পানিতে তলিয়ে গেছে।
অপরদিকে উপজেলার পশ্চিমাংশের রেল লাইনের উঁচু রাস্তাটির কারণে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে হারবাং, বরইতলী, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পূর্ববড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা, বিএমচর, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। তার ওপর ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় তলিয়ে যাচ্ছে ক্ষেতের ফসলও।
স্থানীয় জনপ্রতনিধিরা জানিয়েছেন লাগাতার বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে উপজেলার চিংড়ি জোনের মৎস্য প্রকল্পসমূহ পানিতে তলিয়ে গিয়ে বিপুল পরিমাণ মাছ পানিতে ভেসে যাওয়ার আশংকা দেখা দেবে।
চিরিংগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন জানান, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়িজোন পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে শত কোটি টাকার মাছ পানিতে ভেসে যাওয়ার আশংকা রয়েছে ।
বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার বলেন, ভারী বর্ষণে মাতামুহুরী নদীর ঢলের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় আমার ইউনিয়নের পহরচাঁদার মানুষ পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। সড়ক গুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় লোকজন নৌকা দিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে।
গতকাল সকাল থেকে বানিয়াছাড়া টু পেকুয়া বারবাকিয়া সড়কে চলাচল রাস্তায় কুতুববাজার প্রকাশ ডান্ডিবাজার এর দুই পাশ ২-৩ ফুট পানির নীচে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ভারী বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে বরইতলী ইউনিয়নের বেশিরভাগ নিচু এলাকার জনবসতি পানিতে একাকার হয়ে গেছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে পানিবন্দি মানুষ।
সুরাজপুর-মানিকপুরের ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক বলেন, আমার ইউনিয়নটি একেবারে মাতামুহুরী নদী লাগোয়া। নদীতে পানি বাড়তে থাকায় এলাকার রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লোকজন। অনেকের ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় রান্নার কাজ বন্ধ রয়েছে ।
লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা কাইছার বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত আর মাতামুহুরী নদীতে ঢলের পানি নামায় আমার ইউনিয়নের নিচু এলাকা বুধবার দুপুরে পাব্লিত হয়ে গেছে। চকরিয়া সরকারি বিশ^বিদ্যালয় কলেজ, আমজাদিয়া রফিকুল উলুম মাদরাসাসহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়েছে হাটু সমান পানি। দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
চকরিয়া পরিবেশ সাংবাধিক ফোরামের সভাপতি এম আর মাহমুদ জানান, উপজেলার চারিদিকে বিভিন্ন ধরণের উঁচু রাস্তা ও বাঁধ থাকায় ভারী বর্ষণ ও নদীর পানি ভাটির দিকে নামতে পারছে না। এতে ডুবে যাচ্ছে লোকালয়। এই অবস্থায় বিপদসীমা অতিক্রম করে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের পানিও নামতে শুরু করেছে মাতামুহুরী নদীতে। এতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখিন হবেন চকরিয়ার মানুষ।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে উপজেলার মাঝারি বৃষ্টিপাতে ফলে পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের আশংকা দেখা দিয়েছে। এছাড়া ভুমি ধ্বসের আশংকা রয়েছে। ইতোমধ্যে উপকুলের মৎস্য ঘেরের স্লুইস গেইটগুলো খুলে দেয়া হয়েছে।
পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান করা লোকজনকে সমতলের নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। বন্যার আশংকা দেখা দিলে মানুষজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সার্বক্ষণিক এলাকার খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
পাঠকের মতামত: