সাংবাদিকতা একটি দায়িত্বশীল পেশা। আবার মহান পেশাও! সংবাদকে বলা হয় ‘ইতিহাসের প্রথম খসড়া’। আজ যা খবর, আগামীকাল তা’ ইতিহাস। সময়ের দলিল।
‘খবর’ বা ‘সংবাদ’ সময়কে ধরে রাখে পত্রিকার পাতায় পাতায়। যদিও অডিও-ভিডিও মাধ্যমও সেই একই কাজ করে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে পত্রিকার কথাই বেশি উঠে আসে। তাই পত্রিকার কথা বলা! যে কোনো মাধ্যমের খবর বা সংবাদ এক সময় ইতিহাসের উপাদান হয়ে ওঠে। একজন সাংবাদিকের কাছে তাই খবরের বস্তনিষ্ঠতা দাবি করে। খবরের ’ভারসাম্য’ চায়। তা’ না থাকলে, খবরে পক্ষপাতিত্ব থেকে যায়। এতে করে সংবাদ মাধ্যমের প্রতি পাঠক-দর্শক-শ্রোতার আস্থাও কমে যায়। পরবর্তীতে সে সংবাদ মাধ্যম খুব দ্রুত কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। কিন্তুু ইতিহাস গড়তে একজন সাংবাদিকের দায় অনেক বেশি হয়ে থাকে।
একজন সত্যিকারের সাংবাদিক মন যা চায়, তা’ লিখতে পারেন না। কারণ তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন। আবার তিনি বিবেকেরও ঊর্ধ্বে নন। তার লেখার দায়-দায়িত্ব তাকে বহন করা ছাড়াও পত্রিকার ওপরও সে দায় এসে পড়ে। সে জন্য একজন সাংবাদিককে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়; সন্দেহ প্রবণ হতে হয়। তাকে ভাবতে হয়, তিনি যা লিখছেন, তা’ কী জনস্বার্থের পক্ষে? তার লেখার কারণে কোনো নির্দোষ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না তো!
সাংবাদিকতা মহান পেশার একটি। যদি কেউ সাংবাদিক হতে চান, তবে তাকে মনে-প্রাণেই সাংবাদিক হতে হয়। মনে-প্রাণে সৎ থাকতে হয়! তারও আগে তাকে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে হয়। নিজেকে ধর্ম, ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখতে হয়। একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে ঘটনা কিংবা খবরকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে হয়। একজন সাংবাদিককে খবরের পেছনে আর কী কী বিষয় আছে, তা’ জানতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। আপাত সত্যি, সত্যি না-ও হতে পারে। এখন যা সত্যি বলে মনে হচ্ছে, পরবর্তীতে তা’ একেবারে মিথ্যাও প্রমাণিত হতে পারে। তাই একজন সাংবাদিককে খুব তীক্ষ্ম হতে হয়। মন চাইলেই সাংবাদিক হওয়া যায় না। তার জন্য নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করতে হয়। প্রকাশিত খবরের দায়-দায়িত্ব নেয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হয়। নিজেকে মানবিক করে গড়ে তুলতে হয়। এ ছাড়াও একজন সাংবাদিককে সবসময় নিজের বিবেকের কাছেও জবাবদিহি থাকতে হয়। বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকলে একজন সাংবাদিক তার সাংবাদিকতার দায়-দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়ে ওঠেন।
সাংবাদিকের অধিকার বলতেও একটা কথা আছে। সে অধিকার হচ্ছে, সত্য প্রকাশের অধিকার। সত্য প্রকাশে তিনি হবেন অবিচল! কিন্ত সাংবাদিক কি তথ্য গোপন করবেন? তথ্য বিকৃত করবেন? এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে, নাহ্! তা’ তিনি পারেন না। সাংবাদিকতা একটি স্বাধীন পেশা। এ পেশা গ্রহণ করতে কোনো ধরনের ‘লাইসেন্স’-এর প্রয়োজন পড়ে না। তাই তথ্য বিকৃতি কিংবা তথ্য গোপন করার জন্য তার লাইসেন্স বাতিলের কোনো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু একজন আইনজীবীর, ডাক্তারের তার পেশায় আসতে লাইসেন্স-এর দরকার পড়ে। একজন আইনজীবী কিংবা একজন ডাক্তার ভুল করলে, অভিযুক্ত হলে তার লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। লাইসেন্স লাগে না বলে. একজন সাংবাদিকের দায় অনেক বেশি। সমাজ তার কাছ থেকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে। সত্য প্রকাশে তাকে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি ধৈর্যশীল এবং বস্তুনিষ্ঠ হতে হয়।
‘নৈতিকতা’? সেটি আরো অনেক বড় ব্যাপার! নৈতিকতা ছাড়া একজন সাংবাদিক সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতাই রাখেন না। সাংবাদিকের অস্ত্র- কলম। তিনি যা ইচ্ছা, তা-ই লিখতে পারেন। এ ব্যাপারে তিনি স্বাধীন! কিন্তু স্বাধীনতা মানে যথেচ্ছাচার নয়। তাকে দেশের আইন, সংস্কৃতি, রুচি মাথায় রেখে কলম ধরতে হয়। এর সাথে আরো একটা প্রশ্ন জড়িত। সেটি হচ্ছে, মানবিক বোধের বাইরে তিনি কিছুই করতে পারেন না। একজন মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষই কেবল সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
একজন সাংবাদিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হবেন না; কিন্তু ঘটনা সম্পর্কে তিনি সংবেদনশীল থাকবেন। নিজেকে একটি নিরপেক্ষ জায়গায় রেখে ঘটনাকে বিশ্লেষণ করবেন। ঘটনা বিচার করবেন যুক্তি ও কারণ দিয়ে; আবেগ দিয়ে নয়। তাকে মনে রাখতে হবে যে, কোনো কারণ ছাড়া কোনো ঘটনা ঘটে না। ঘটনার পেছনে অবশ্যই কোনো না কোনো কারণ আছে। চোখের সামনে যা দেখছি, তা’ সত্যি নাও হতে পারে। কখনো কখনো বোঝার ভুলও হতে পারে। চুলচেরা বিশ্লেষণই একজন সাংবাদিককে সত্যসন্ধানী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
আরো একটি কথা মনে রাখা দরকার। তা’ হচ্ছে, একজন সাংবাদিক কিন্তু বিশেষজ্ঞ নন। তিনি একজন বিশেষজ্ঞ এবং পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে সেতু বন্ধন করেন মাত্র। এজন্য অবশ্য একজন সাংবাদিককে অনেক বেশি সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি সচেতন হতে হয়। তাকে এসব বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা করতে হয়। এ ছাড়াও দেশের আইনব্যবস্থা সম্পর্কেও তাকে সম্যক ধারণা রাখতে হয়।
সাংবাদিকতা করবো অথচ আইন সম্পর্কে কিছুই জানবো না, সংবিধান পড়বো না, তা’ হয় না। সাংবাদিকতা করতে গেলে প্রথমেই সংবিধানখানি পড়ে নিতে হয়। কোনো খবরে সংবিধান লংঘন হচ্ছে কিনা, আদালত অবমাননা হচ্ছে কিনা, কারো মানহানি ঘটাচ্ছি কিনা, তা’ লক্ষ রাখা দরকার। কারণ ‘মানহানি’ নামে একটি শব্দ আছে, যার মুখোমুখি একজন সাংবাদিককে হওয়া লাগতে পারে। এ জন্য নিজেকে তৈরি রাখতে হয়। মানহানিকর খবর ছাপার আগে সেই খবরটি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতে হয়। তা’ না-হলে তাকে আইনের কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। অসত্য, ভারসাম্যহীন এবং তথ্যবিকৃতির দায়ে তার সাজাও হতে পারে। তাই সাংবাদিকতা অনেক বড় দায়িত্বশীল পেশা। একে অন্যান্য পেশার মতো দেখার সুযোগ নেই।
অপরাধ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিককে অনেকে বেশি সতর্ক থাকতে হয়। কারণ, একজন ব্যক্তি ‘অভিযুক্ত’ হলেই যে তিনি ‘অপরাধী’ হয়ে যাবেন, এমন কোনো কথা নেই। যতক্ষণ না আদালত তাকে ‘অপরাধী’ হিসেবে রায় দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি ‘অভিযুক্ত’ হতে পারেন, কিন্তু ‘অপরাধী’ নন। কখনো কখনো প্রকাশিত সংবাদে একজন অভিযুক্তকে ‘সন্ত্রাসী’,‘খুনি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটি কখনোই এভাবে উল্লেখ করা উচিত নয়। কারণ, আদালতের রায়ে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারেন। তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে, তিনি প্রকাশিত সংবাদকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। মানহানির মামলা করতে পারেন।
একজন সাংবাদিক কিন্তু পুলিশ নন। তাই তিনি কাউকে জেরা করতে পারেন না। তিনি শুধু ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারেন, কী হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, তা’ তিনি কৌশলে জেনে নেবেন। কেন ঘটনাটি ঘটেছে কিংবা কেন ঘটেনি, তা’ তার কৌতূহলী চোখ, সন্দেহপ্রবণ মন এবং বিশ্লেষণী যুক্তি দিয়ে বিচার করবেন। নিজেকে কখনো পুলিশের ভূমিকায় নামানো যাবে না। কখনো কখনো আমরা এই বড় ভুলটা করে ফেলি। এ ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে তথ্য সংগ্রহ করার পদ্ধতি হিসেবে তিনি একেবারে সাধারণ মানুষের কাতারে মিশে যেতে পারেন, অনেকটা একজন গোয়েন্দার মতোই। কিন্তু তাকে মনে রাখতে হবে, তিনি গোয়েন্দা সংস্থায় চাকরি করছেন না; তিনি একজন সত্যসন্ধানী মানুষ! সত্যকে আলোয় আনাই তার কাজ! বরং তার সংবাদের সূত্র ধরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তদন্তের কোনো ধারা খুঁজে পেতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রেও বস্তুনিষ্ঠতার স্বাক্ষর রাখতে হবে।
ইদানিং মফস্বল সাংবাদিকতার ইতিবাচক এবং নেতিবাচকদিক জনগণ প্রত্যক্ষ করছেন। মফস্বলে সাহসী সাংবাদিকতা করা সত্যিই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও অনেক সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকতা করে থাকেন। তিনি যাদের বিরুদ্ধে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাঠান, তারা ক্ষিপ্ত হয়ে সরাসরি তাদের গায়ে হাত তোলেন কিংবা মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেন। কখনো কখনো জীবন বাঁচাতে সাংবাদিককে বাড়ি-ঘর পর্যন্ত ছাড়তে হয়। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ সরকারি কোনো কর্মকর্তা কিংবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী হয়ে থাকেন। তাদের দাপটে সৎ সাংবাদিককে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। অথচ তার কোনো নিরাপত্তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিংবা পত্রিকা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে পারে না। ফলে তারা কী করবেন ভেবে পান না। হতাশায় ভোগেন। অন্যদিকে, কিছু সাংবাদিক আছেন যারা তাদের দায়িত্ববোধের কথা ভুলে যান। খবর প্রকাশের ভয় দেখিয়ে কারো কারো কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে থাকেন। তাদেরকে সাধারণ জনগণ সাংবাদিক না-বলে ‘সাংঘাতিক’ বলে অভিহিত করেন। এতে করে সৎ সাংবাদিকেরা বিব্রতবোধসহ লজ্জায় পড়ে যান। সাংবাদিকতার ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। সাংবাদিকতাকে কোনোভাবেই প্রশ্নের মুখোমুখি করা যাবে না। এখনো মানুষ সাংবাদিকদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেন; এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না।
পরিশেষে, বলতে চাই- একজন সাংবাদিকের কাজের ঝুঁকি অনেক। ঝুঁকি মাথায় নিয়েই একজন সাংবাদিককে কাজ করতে হয়। ঝুঁকি না-নিলে সৎ সাংবাদিকতা করা যায় না। একজন নির্ভীক সাংবাদিকই শেষ পর্যন্ত তার দায়-দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন এবং তার লেখা সংবাদই এক সময় ইতিহাস তৈরি করতে পারে। ইতিহাস তৈরির দায়-দায়িত্ব-ই একজন সাংবাদিককে অধিকতর দায়িত্বশীল করে তুলতে পারে বলে সবাই বিশ্বাস করেন। একজন সাংবাদিককে অবশ্যই তা’ সব সময় মনে রাখতে হবে।
লেখক: সেলিম উদ্দিন, সম্পাদক ও প্রকাশক- সাপ্তাহিক আলোকিত ঈদগাঁও (প্রস্তাবিত)
পাঠকের মতামত: