পার্বত্য চট্রগ্রাম প্রতিনিধি :::
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের কাছে খাবার হিসেবে ‘বাঁশ কড়ুল’ এবং বাঁশে রান্না করা খাবার; দুটিই সবচেয়ে প্রিয়। আজকাল বাঙালিরাও ‘বাঁশ কড়ুল’ খেতে বেশ অভ্যস্ত। বিশেষত পর্যটকদের কাছে সুস্বাদু রেসিপি ‘বাঁশ কড়ুল আর বেম্বো চিকেন’।
শুধু কড়াইয়ের পরিবর্তে বাঁশের চোঙায় রান্না করাই নয়; মজাদার তরকারি হিসেবেও ‘বাঁশ কড়ুল’ এর কদর রয়েছে। যদিও এই ব্যবস্থাটি পাহাড়ি জীবনের শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী অনুষঙ্গ বিশেষ। বাঁশের চোঙায় রান্না করা খাবারগুলোর মধ্যে ‘বেম্বো চিকেন’ সবচেয়ে জনপ্রিয় রেসিপি।
তবে এটা ঠিক, দিনে দিনে বাঁশে রান্না করে খাওয়ার প্রচলন কিছুটা হলেও কমছে। শহুরে পাহাড়ি সমাজে অনেকটা বিলুপ্তির পথে। এর মধ্যেও পাহাড়িদের কিছু কিছু পরিবার প্রাকৃতিক উপায়ে রান্নার ধরনটি টিকিয়ে রেখেছে। বিশেষত জুমচাষনির্ভর পাহাড়িরা একদিকে ঐতিহ্য হিসেবে অন্যদিকে বাঁশে রান্না মজাদারের কারণে তা ধরে রাখেন। ব্যতিক্রমী হিসেবে শহরে বসবাসকারী হাতেগোনা কিছু পাহাড়ি পরিবারকে কদাচিত্ বাঁশে রান্না করে খেতে শোনা যায়। তাঁদের মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের খাগড়াপুরের হাদুকপাড়ার সাহিত্যিক গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরার নাম উল্লেখ করা যায়।
আদিবাসী গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরা জানালেন, বাঁশে রান্নার ধারণা নতুন কিছু নয়। মানুষ যখন থেকে রাঁধতে শিখেছে, তখন থেকেই বাঁশে রান্নার প্রচলন শুরু। আদিম যুগে পুড়িয়ে খেতে শেখার পরই ধাপেই বাঁশে, এর পর মাটির হাঁড়িতে রান্না করতে শুরু করে মানুষ। উন্নতির ছোঁয়ায় কেউ কেউ রান্না পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে মাত্র। প্রান্তিক মানুষদের আজ হাজার বছর পরও সেই বাঁশেই রান্না করে খেতে দেখা যায়।
আরেক গবেষক মংসানু মারমার মতে, কেবল জীবনমান উন্নয়নের কারণেই মানুষ রান্না বাঁশে ছেড়ে আধুনিক নানা উপকরণে করছেন তা নয়। বাঁশের চোঙায় রান্না-বান্নায় স্বাদই আলাদা। সুস্বাদু। চমত্কার সুঘ্রাণ। তিনি জানান, বিশেষত প্রত্যন্ত এলাকার ত্রিপুরা ও মারমা নৃ-গোষ্ঠীর পাহাড়িরা এখনো বাঁশে যাবতীয় রান্না করে খেয়ে থাকেন।
আজকাল দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ হলো-বাঁশের চোঙায় রান্না করা পাহাড়ি খাবার-দাবার এবং বাঁশ কড়ুলের তরকারি। চাহিদা এমন বেশি যে, পাহাড়ে বেড়াতে এলে বাঁশের রেসিপি খাদ্য তালিকায় থাকবেই। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-বেম্বো চিকেন, ছোট মাছ, গুদায়া, শাক-সবজি, ভাত প্রভৃতি।
জনপ্রিয় বেম্বো চিকেন : বেম্বো চিকেন। এক প্রকার পাহাড়ি রেসিপি। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক মানুষের কাছে এটি নিয়মিত ব্যাপার হলেও অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষের জন্য আলাদা কিছু। বেম্বো চিকেন বা বাঁশের চোঙায় রান্না করা মুরগির মাংসের কথা বলছি। বিশেষ পদ্ধতির এই খাবার দিনে দিনে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। পর্যটক হলে তো কথাই নেই। পাহাড়ে বেড়াতে আসলেই আগন্তুক পর্যটক খেতে চান বেম্বো চিকেন। এটি এত মজা, এত মজা, এত মজা যে, শুনলেই যে কারো জিভে জল এসে যায়। স্বাদ, গন্ধ আর ভিন্ন ধরনের ফ্লেভারের কারণে বেম্বো চিকেন এর এত বিশেষত্ব।
কী ধরনের বাঁশে ভালো রান্না হয়; তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অবিতর্কিত ব্যাপারটা হলো অবশ্যই তা হবে কাঁচা বাঁশ। কাঁচা এ জন্য যে, বাঁশ কাঁচা না হলে দ্রুতই আগুনে পুড়ে যাবে। উপকরণ সিদ্ধ হবে না। বিশেষ করে ডুলু আর মুলি বাঁশেই রান্না ভালো হয়। অপেক্ষাকৃত মোটা বাঁশকে গিরা রেখে চাহিদামতো কেটে নিন। এর পর বাঁশ চোঙাটি সামান্য পানিতে ধুয়ে নিলে ভালো।
রন্ধনশৈলী : বাঁশে রান্না করার নিয়ম-কানুন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতও আছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল রয়েছে। রান্নার প্রণালি সম্পর্কে কথা হয়েছে খাগড়াছড়ির পরিচিত পাহাড়ি খাবার রেস্টুরেন্ট ‘সিসটেম’ এর উদ্যোক্তা মংসানু মারমা (মং), ‘খাংময় রেস্তোরাঁ’র স্বত্বাধিকারী সুইচিং মারমা এবং ঘরোয়াভাবে মজাদার খাবার তৈরিতে বিশেষ পারদর্শী প্রতিভা ত্রিপুরার সাথে। তাঁরা জানালেন, বেম্বো রেসিপির আদ্যেপান্ত।
প্রতিভা ত্রিপুরা তাঁর ঘরে যেভাবে বেম্বো চিকেন তৈরি করেন, এর রেসিপি হলো-‘আধা কেজি ওজনের দেশি মুরগি। হালালমতো জবাই করুন। এর পর ছোট ছোট পিস করুন। ভালোভাবে ধুয়ে নিন। পিঁয়াজ কুচি, আদা বাটা, হলুদ, মরিচ, ধনিয়াপাতাসহ পরিমাণমতো তেল ও লবণ মিশিয়ে আঙুলের ছিটকা পানিতে মাংসের সাথে ভালো করে মাখিয়ে নিন। মনে রাখবেন, মরিচ হবে কাঁচা এবং তা হবে আধাবাটা। অন্তত ১০/১৫ মিনিট মাখিয়ে রাখতে হবে। এর পর কাঁচা বাঁশের চোঙার মধ্যে মাখানো মাংস ঢুকিয়ে কলাপাতা দিয়ে মুখ বন্ধ করতে হবে। সব ঠিকঠাক থাকলে-বাঁশটি আগুনের কয়লায় বসিয়ে দিন। মনে রাখবেন, প্রবেশদ্বারটি কমপক্ষে থার্টি এঙ্গেল উপরে রাখবেন। এর পর আগুনের ছেকা শুরু। এরপর আগুনের তাপ বিবেচনায় বাঁশটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিন। এভাবে মুরগি বা পাখি জাতীয় মাংস রাঁধতে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট সময় লাগতে পারে। তবে ভাঁপ বের হবার পর ফ্লেভার পেলেই বুঝবেন, বেম্বো চিকেন রেসিপি হয়ে গেছে। ’
গ্যাসের আগুনেও বেম্বো চিকেন করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো-রেসিপি মজাদার করতে কখনোই অন্য কোন ধরনের মসলা ব্যবহার করা যাবে না। এতে বেম্বো চিকেন খাবার অনুপযোগী হয়ে যেতে পারে। এটিও বেম্বো চিকেনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কেবল বেম্বো চিকেনই নয়; মাছ, ডিম, শাক-সবজি ও ভাত বাঁশের চোঙায় রান্না খুব মজাদার হয়ে থাকে। জেনে রাখা ভালো যে, আঁশযুক্ত কোনো খাদ্যই বাঁশে রান্না করা যাবে না। পাহাড়িদের ‘বাঁশে গুদায়া’ অন্যতম সুস্বাদু খাবার। বাঁশে পিঠাপুলিও হয়ে থাকে। মারমাদের ‘কেদামু’ অন্যতম।
খাগড়াছড়ির পরিচিত পাহাড়িয়া রেস্টুরেন্ট সিসটেম, খাংময়, ইজর, টং, জুমঘরসহ সব কটি রেস্তোরাঁয় বেম্বো চিকেন পাওয়া যায়। তবে, সিসটেম আর খাংময় রেস্টুরেন্ট এর ‘বেম্বো চিকেন’ এর বেশ সুনাম আছে। জেলা সদরের পানখাইয়াপাড়ার ‘সিসটেম রেস্টুরেন্ট’ এর মং দাদা বলেন, ‘ইদানীং বেম্বো চিকেন এর অর্ডার খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত শুক্র, শনিবার খাগড়াছড়িতে পর্যটক এলে প্রথমেই বেম্বো চিকেন খেতে চান। অর্ডার পেলে আমরা যথাসম্ভব কম দামে তা পরিবেশন করি। তবে, কাঁচা বাঁশ সংগ্রহ করতে সমস্যায় পড়তে হয়। ’
খাগড়াছড়িতে বেড়াতে আসা পর্যটক নুর হোসেন পল্লবের সাথে দেখা হয় সিসটেম রেস্তোরাঁয়। আরো বন্ধুদের নিয়ে তিনি বেম্বো চিকেন খাচ্ছিলেন। বললেন, ‘এমন ফ্লেভারের খাবার আগে কখনো খাইনি। পাহাড়ি এই রেসিপি এমন মজা হতে পারে আগে ভাবিনি। ’
পাঠকের মতামত: