হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ:
১ দিনেই মাত্র ৪ ঘন্টার ব্যবধানে মংডু থেকে টেকনাফে এসেছে ৭৩১ জন রোহিঙ্গা। পারাপারের জন্য নৌকা সংকটের কারণে ভেলায় চড়ে রোহিঙ্গাদের নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ সীমান্তে অনুপ্রবেশের প্রবনতা দিন দিন বাড়ছে। সেই সাথে নৌকায় করে রাতের আঁধারেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। ১০ নভেম্বর শুক্রবার দুপর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আবারও মিয়ানমার থেকে বাঁেশর ভেলা ভাসিয়ে পালিয়ে এসেছে ৭ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু। এসব রোহিঙ্গা ১০টি ভেলায় করে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ নয়াপাড়া এবং টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া পৌঁছায়। এনিয়ে গত ৩ দিনে ১ হাজারেরও বেশী রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু ভেলায় চড়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের টেকনাফ উপকুলে পৌঁছেছে। এছাড়া আরো ৪টি ভেলা নিয়ে ৩ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষ বাংলাদেশের ঢুকার অপেক্ষায় নাফ নদীতে ভাসছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা বাহিনী ও রাখাইনদের নির্যাতন বন্ধ হলেও বন্ধ হয়নি ভয়-ভীতি। রাখাইনদের সঙ্গে নিয়ে সেনা বাহিনীরা রাতে গ্রামে গ্রামে গিয়ে গুলি বর্ষন ও ধরপাকড় করেছে। যাতে রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। পারাপারের জন্য নৌকা সংকটের কারণে রোহিঙ্গারা এখন মিয়ানমার থেকে ভেলা ভাসিয়ে রাখাইন রাজ্যে ছেড়ে নাফ নদী পেরিয়ে পালিয়ে আসছেন টেকনাফে। বৃহস্পতিবার ৯ নভেম্বর সকাল সাড়ে নয়টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত টেকনাফ উপজেলায় শাহপরীরদ্বীপে দুটি ও সাবরাং নয়া পাড়া ১টিসহ মোট ৩টি ভেলায় ১৮০ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। তারমধ্যে ৯৪ জন শিশু, ৪৯ নারী এবং ৩৭ পুরুষ ছিল।
এদিকে উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে দিয়ে বুধবার ৮ নভেম্বর দিবাগত রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার ৯ নভেম্বর সকাল ৬টা পর্যন্ত নতুন করে আরও ৭৩১ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। পরে তাদের সেনাবাহিনীর ত্রাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে পাঠানো হয়েছে।
ভেলায় করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গা আবদুল মজিদ বলেন ‘মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার জন্য নৌকা পাওয়া যাচ্ছেনা। তাই প্লাস্টিকের জারিকেন, কাঠের তক্তা ও রশি দিয়ে ভেলা বানিয়ে চলে এসেছি। মিয়ানমার সীমান্তে অপেক্ষমান রোহিঙ্গারা আরও ১২-১৫টি নতুন করে ভেলা তৈরি করছেন। বুধবার ৮ নভেম্বর একটি ভেলায় পরীক্ষামূলক ভাবে ভাসিয়ে আসতে পারায় এখন রোহিঙ্গারা ভেলার সাহায্যে পাড়ি দিচ্ছে’। রোহিঙ্গারা আরও বলেন ‘ভেলা ভাসানোর আগে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছিল। শিশুদের নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয় বেশি। জোয়ারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারী, পুরুষরা বৈঠার সহযোগিতায় পৌছাতে পেরেছি’।
সাবরাং হারিয়াখালী সেনা ত্রাণ কেন্দ্রে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্বে নিয়োজিত টেকনাফ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মো. আলমগীর কবির বলেন ‘উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে নতুন অনুপ্রবেশকারী ১৬০ পরিবারের ৭৩১ জন রোহিঙ্গাকে ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যা¤পে পাঠানো হয়েছে’।
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এসএম আরিফুল ইসলাম বলেন ‘ভেলায় করে আসা রোহিঙ্গাদের জড়ো করে মানবিক ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে সেনা বাহিনীর মাধ্যমে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে’।
উল্লেখ্য, পরিবহনের নৌকা সংকটের কারণে নিজেরা তেলের খালী জারিকেন দিয়ে বাশেঁর ভেলা বানিয়ে পারিবারদের নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। তাঁদের ভাষ্য মতে মিয়ানমার সেনা বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতন এখনো অব্যাহত রয়েছে। যুবক ছেলেদের আটক করে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করছে ও যুবতী নারীদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে কাউকে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। এসব অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নৌকাও না পেয়ে বিকল্প পথ ব্যবহার করে কোন রকম প্রাণ বাচাঁতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। এখনও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা আসার অপেক্ষায় রয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শুরু থেকে কিছু নৌকার মালিক, মাঝি ও দালালদের যোগসাজসে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা পারাপার করতে গিয়ে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবিতে নাফ নদী ও সাগর তীরবতী এলাকা থেকে প্রায় দুই শতাধিক শিশু, নারী ও পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে স্থানীয় প্রশাসন নৌকা চলাচলের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ করে দেয়। এরপরও রোহিঙ্গা রাতের আধাঁরে নৌকায় করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে। গত কয়েকদিন ধরে সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ ও নৌকার মাঝি, মালিক ও দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করায় রোহিঙ্গারা এখন ভেলায় করে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পাড়ি দিচ্ছেন।
পাঠকের মতামত: