আব্দুল মালেক, সেন্টমার্টিন :: সেন্টমার্টিন দ্বীপের বয়স প্রায় আড়াইশ বছর। ধারণা করা হয় আড়াইশ বছর আগে সেন্টমার্টিনের আয়তন ছিলো প্রায় ৩১ বর্গ কিলোমিটার। বিট্রিশ সরকারের সমীক্ষায় তথ্যে ২৮ বর্গ কিলোমিটার। আশির দশকে এসে দ্বীপের আয়তন হয় ১৭ বর্গ কিলোমিটার। আবার উনিশ দশকে এসে ১২ বর্গকিলোমিটার। আর বর্তমানে ভাঙনের কারণে ছোট হয়ে ৮ বর্গ কিলোমিটার। ভাটার সময় ১০ থেকে ১৫ বর্গ কিলোমিটার দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।
৮ বর্গ কিলোমিটারে পর্যটন সমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন বঙ্গোপসাগরের অতল গহ্বরে বিলীনের দৌঁড়গোড়ায়। প্রতি বছরের মত এ বছরও জোয়ারের হিংস্র তান্ডবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে সাগর কন্যা দ্বীপ সেন্টমার্টিন্সের আয়তন। দিনের পর দিন লোক বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে বাংলাদেশের গর্বের ধন ও হীরের টুকরো এ দ্বীপ।
উর্বর মৌসুমে স্বদেশসহ বাইরের ভিভিআইপিরা এ দ্বীপে ভ্রমণে আসলেও কেও বুঝতে চান না এর নীরব কান্নার অর্থ। এ দ্বীপ ও দ্বীপের মানুষের আর্তনাদ পৌঁছেনা সেসব ভিভিআইপিদের কান পর্যন্ত।
এখানে বসবাসরত নিরীহ মানুষগুলোর জীবনের পরি-সমাপ্তি সাগর পাড়ে হলেও তাদের আশা আকাঙ্খার শেষ নেই। তারাও নিরাপদ ও আতঙ্কহীন জীবন পরিচালনার আকাঙ্খায় শতাব্দীর পর শতাব্দী তাদের স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখেন।
জুন-জুলাই মাস আসে, আবার যায়, ফের আসে।
দ্বীপের অসহায় শিক্ষিত সমাজগুলো পত্রিকা বা সোস্যাল মিডিয়ার পাতায় পাতায় ভীত সন্ত্রস্ত চোখগুলো জ্বালিয়ে রাখে বাতাসে নিভু নিভু বাতির মত। এ বাজেট অতীত হয়ে অন্য বাজেট আসে,ফের ঐ বাজেট অতীত হয়ে আরেক বাজেট আসে কিন্তু কোন বাজেটে হতভাগা ভাঙ্গন নামক ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত সেন্টমার্টিনের জন্য কোন বাজেট পাশ হয় না।
যখন পত্রিকার পাতায় ভেসে বেড়ায় যে,
টেকনাফের জইল্লার ডিয়ার জন্য এত’শ কোটি টাকা। সাবরাং এর জন্য এত’শ কোটি টাকা কিংবা উখিয়ার পাতা বাড়ি,অথবা হোয়াক্যং এর লম্বা বিলের জন্য এত’শ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তখন হতাশাগ্রস্ত সেন্টমার্টিনের মানুষগুলো আরেকটি বাজেটের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে।
এভাবে যুগের পর যুগ পূর্ণিমার জোয়ার কিংবা প্রাকৃতিক নানান দূর্যোগের আঘাতে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের এ বিশ্ব সুন্দরী সাগর কন্যা সেন্টমার্টিন। মিস আয়াল্যান্ড প্রীয়তীর মত হুবহু দেখতে এ দ্বীপটি স্বদেশের সীমাহীন অবহেলায় হারিয়ে ফেলছে নিজের সৌর্য-বীর্য।
বিশ্বায়নের এ যুগে সারা বাংলার মানুষের জীবন যাত্রার মান প্রয়োজনের সমানে সমানে এগিয়ে গেলেও সেন্টমার্টিনের মানুষের জীবন যাত্রার মান নিম্নমুখিই রয়ে গেছে।
দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু ডেইল ছিলো দ্বীপের পশ্চিম বীচে আবকাশের ডেইল আর আব্দুর রাজ্জাকের ডেইল। উত্তর বীচে ছিলো বড় ডেইল। উত্তর বীচের এই বড় ডেইলে প্রায় ১০০ পরিবারের বসবাস থাকায় এটির নাম ডেইল পাঁড়া। উঁচু মাটির স্থানকে টিলা বা ডেইল বলা হয়।
গত কয়েক বছরে বর্ষার উত্তাল সমুদ্রের ঢেউতে আব্দুর রাজ্জাকের ডেইল আর অবকাশের ডেইল ভেঙে এখন সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে।
১৯৯৭ সনের আগে উত্তর বীচে বড় ডেইল বা ডেইল পাড়ায় প্রায় ১০০ টি পরিবারের বসবাস ছিলো। পাশেই কেন্দ্রীয় কবরস্থান। ১৯৯৭ এর ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্রের তান্ডবে পানিতে তলিয়ে যায় ডেইল পাড়া। ভেঙে যায় কেন্দ্রীয় কবরস্থানেরও বেশ কিছু অংশ। পরে সরকারী অর্থায়নে ক্ষতিগ্রস্ত ১০০ পরিবারদের দ্বীপের হলবনিয়া নামক জায়গায় টিনের আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে দেন ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। স্থানীয়রা লম্বাঘর নামে চিনেন।
আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা দিল মোহাম্মদ বলেন, ২ রুমের একটি ছোট্ট টিনের বাড়িতে ২৩টি বছর পার করে দিলাম। বাপদাদার জমি আর বাড়িঘর এখন সমুদ্রতে। আগের জিনজিরা এখন আর নেই। দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে।
আমার বাড়ির থেকে সমুদ্র দেখা যেতোনা। সমুদ্র বা সাগর দেখতে হলে বাড়ির পশ্চিম পাশে থাকা বিশাল ডেইল পার হয়ে যেতে হতো। প্রায় ৪/৫ মিনিট সময় লাগতো সাগর পাড়ে নামতে। আর এখন ঘরের বারান্দায় আসে জেয়ারের পানি। আমার ঐ বিশাল মাটির ডেইল ভেঙে নিয়ে গেছে রাক্ষসী সমুদ্র। এসব কথা বলেন পশ্চিম পাড়ার আব্দুর রাজ্জাক। তিনি আরো বলেন, কখন যে নিজের ঘরটাও সমুদ্রে তলিয়ে যায় একমাত্র আল্লাহ জানেন। বর্ষামৌসুম আসলে আতংকে থাকতে হয়। সরকার যদি একটি বেড়িবাঁধ করে দেয় তাহলে সমুদ্রের ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পাবে দ্বীপ আর বেঁচে থাকবো আমরা।
উত্তর পাড়ার প্রবীণ মুরব্বি মুছা আলী বলেন, “অ্যার বয়স ৯৫ বছর চলের। আগর ডিয়া আর এহনর ডিয়া এক নাই। ডিয়া ভাগি অর্ধেক অই গিয়েগই। বেড়িবাঁধ নদিয়ে হত্তে যে ডিয়া ভাঙি পানি অই জাগই আল্লাহ ভালা জানে”
অর্থাৎ- আমার বয়স ৯৫ বছর চলছে। আগের দ্বীপ আর এখনের দ্বীপ এক নাই। দ্বীপ ভেঙে অর্ধেক হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ না দিলে কখন যে দ্বীপটি ভেঙে যায় তা আল্লাহই ভাল জানেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন সেন্টমার্টিন পর্যটন শাখার সাধারণ সম্পাদক ব্যবসায়ী জিয়াউল হক জিয়া বলেন, দ্বীপের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ সাইডে জোয়ারের পানিতে অনেক জায়গা ভেঙে গেছে। বীচপাড়ে থাকা কেঁয়াবন ভেঙে পানিতে তলিয়ে গেছে। বর্ষাকালে দ্বীপের চারিপাশে ভাঙন ধরে। এই মুহুর্তে দ্বীপকে টিকিয়ে রাখতে হলে দ্বীপের চারিপাশে একটি টেকসই বাঁধ অতন্ত্য জরুরী হয়ে পড়েছে।
সেন্টমার্টিন বিএন স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক আয়াত উল্লাহ খোমেনি বলেন, সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের। আর বাংলাদেশ সেন্টমার্টিনের। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ভ্রমণপ্রিয় জায়গার নাম সেন্টমার্টিন। এ দ্বীপে পর্যটক আসলে সরকারের রাজস্বে আয় হয়। দ্বীপ বাঁচলে সরকারের আয় বাড়বে। আমাদের দ্বীপ বাঁচলে আমরা ১০ হাজার দ্বীপের বাসিন্দা বাঁচবো। দ্বীপকে বাঁচানো এখন ফরজ কাজ। দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের আকর্শনীয় জায়গা এই সেন্টমার্টিন্স আইল্যান্ড। আকর্শনীয় দ্বীপটি রক্ষা করতে একটি টেকসই বেড়িবাঁধসহ সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
ইউপি সদস্য হাবিব খাঁন বলেন, দ্বীপের ভাঙ্গন রোধের জন্য আমরা স্থানীয়রা নিজ উদ্যোগে কেঁয়া গাছ রোপন করে থাকি। প্রতি বছরই বর্ষামৌসুমে সমুদ্রে ঢেউতে দ্বীপের কেন্দ্রীয় কবরস্থানের উত্তর পাশসহ দ্বীপের দক্ষিণ ও পশ্চিমে কিছু অংশ ভেঙে যায়। দ্বীপের প্যারাক ক্ষ্যাত কেঁয়া গাছ ভাঙ্গন রোধ করে। বালিয়াড়িতে প্যারেকের মতো কেঁয়াগাছের শিকড় মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে। আমাদের নিজনিজ অবস্থান থেকে দ্বীপের চারিপাশে বেশি করে কেঁয়া গাছ ও ঝাউগাছ রোপন করতে হবে। তারপরেও বেড়িবাঁধের কোনো বিকল্প নেই। পরিবেশ সম্মত বাধ নির্মাণ জরুরী। সেটা যে পদ্ধতিতেই হউক দ্বীপ রক্ষা অতীব জরুরী।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণে স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদের কোনো ভুমিকা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন, শীতমওসুমে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে দেশের উচ্চ পদস্থ অসংখ্য কর্মচারী কর্মকর্তারা আসেন। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এম পি, সচিবসহ সরকারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে কর্মকর্তারা আসেন। অনেকেই আসেন ভ্রমণ করতে আবার অনেকেই সরকারী কাজে।
সরকারী কাজে সরকারী বিভিন্ন দপ্তর থেকে আসা প্রতিনিধিদেরকে পরিষদের মিলনায়তনে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের মাননীয় চেয়ারম্যান নুর আহমদসহ আমরা ইউপি সদস্যগণ দ্বীপের নানান সমস্যা ও সমাধানের কথা তুলে ধরি। তারমধ্যে সর্বপ্রথম দ্বীপে টেকসই পরিবেশ সম্মত একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণের কথা বলি। এসব মিটিংএ তারা আমাদেরকে বেড়িবাঁধ নির্মাণে আশ্বস্ত করলেও ঢাকা গিয়ে তা ভুলে যান।
দু’বছর আগে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ(কউক) এর যৌথ উদ্যোগে পরিষদের হলরুমে ‘দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায়’ এক মিটিংএ কক্সবাজার উন্নয় কর্তৃপক্ষ (কউক) দ্বীপের চারিপাশে মেরিন ড্রাইভের আদলে একটি ওয়াক-ওয়ে নির্মাণ করবে বলে আমাদেরকে জানান। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সেন্টমার্টিনে ওয়াক-ওয়ের কাজ বাস্তবায়নসহ দ্বীপ রক্ষার্থে সরকারের প্রতি পরিবেশ সম্মত একটি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবী জানাচ্ছি।
পাঠকের মতামত: