ঢাকা,সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

ভারত-পাকিস্তান কি যুদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি?

helicopterনিউজ ডেস্ক :::

বহু দিন শান্ত থাকার পর আবারও উত্তাপ ছড়িয়েছে কাশ্মীর উপত্যকায়। জনপ্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বুরহান ওয়ানি ভারতীয় বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর থেকে প্রতিবাদে উত্তাল কাশ্মীর। জবাবে ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। চোখ হারিয়েছেন অন্তত শতাধিক কাশ্মীরি। টানা বিক্ষোভে জেরবার কাশ্মীরের উরিতে ১৮ই সেপ্টেম্বর সন্দেহভাজন জঙ্গিদের হামলায় ১৮ ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছেন। আর এর পরপরই আরো একবার মুখোমুখি চিরবৈরী দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। এ হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি-গোষ্ঠীকে দায়ী করছে ভারত। দেশটির দাবি, পাকিস্তান থেকে জঙ্গিরা কাশ্মীরে ঢুকে হামলা চালিয়েছে। জঙ্গিদের হাতে থাকা অস্ত্র সামরিক বাহিনীর কাছেই থাকে সাধারণত। তবে পাকিস্তান এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
হামলার সঙ্গে জড়িতরা শাস্তি ছাড়া পার পাবে না বলে অঙ্গীকার করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। দেশটির রাজনীতিবিদ, জ্যেষ্ঠ সেনাকর্তা, বুদ্ধিজীবী- সবাই পাকিস্তানকে ‘সমুচিত জবাব’ দেয়ার কথা বলছেন। সাবেক ভারতীয় সেনাপ্রধান পাকিস্তানে হামলার জন্য ‘আত্মঘাতী দল’ বানানোর আহ্বান জানিয়েছেন। অনেকে মনে করেন পাকিস্তানে পাল্টা হামলা চালানোর সময় এসেছে। শাসক দল বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা রাম মাধমের ভাষ্য, ‘কৌশলগত’ সংযমের সময় ফুরিয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান রাহিল শরীফ কর্পস কমান্ডারদের একটি বৈঠকে মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তান যেকোনো ধরনের হুমকি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত। তাহলে কি আরেকটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে? নাকি সবকিছু রাজনীতিকদের আর সমরবিদদের বাগাড়ম্বর?
বিবিসির সাংবাদিক সৌতিক বিশ্বাস কথা বলেছেন বেশ কয়েকজন ভারতীয় বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। এদের বেশিরভাগই মনে করেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গিয়ে হামলা চালানোর সক্ষমতা ভারত গড়ে তোলেনি। ভারতীয় গণমাধ্যমে পাকিস্তানের ভেতর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর ব্যাপারে আলোচনা সরগরম। কিন্তু বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, পাকিস্তানের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকায় ভারতের জন্য বিষয়টি সহজ হবে না। নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা মনে করেন, কড়া জবাব দেয়ার মতো সামরিক শক্তি ও পরিকল্পনা মোদি সরকার তৈরি করেনি।
ভারতে বিতর্ক আছে দেশটির ‘কৌশলগত সংযমের’ নীতি নিয়েও। দিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের প্রতাপ ভানু মেহতা মনে করেন, এ সংযম কাজে দিয়েছে ঢের। কারণ, এর ফলেই চীন ছাড়া সবার কাছ থেকে পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পথে চলে গেছে। এছাড়া ভারত এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অবরোধ আরোপের আহ্বান জানানোর অবস্থানে পৌঁছেছে। তবে আরেক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সি ক্রিস্টিন ফেয়ার মনে করেন, এই কৌশলগত সংযমের নীতি অর্থহীন। কারণ, এর ফলে সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না।
তাহলে এখন ভারত কি যুদ্ধে জড়াবে? নাকি কৌশলগত সংযম দেখানোই অব্যাহত রাখবে? কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এ দুই পথের বাইরেও পথ আছে। প্রতিশোধ নেয়ার কথা জনসম্মুখে না বলে, ভিন্ন উপায় বের করতে হবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক একধাপ নিচে নামিয়ে আনা। পাকিস্তানের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরবের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এছাড়া বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যাতে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতাকারী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে সেজন্য কাজ করে যেতে হবে। অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের জন্যও দীর্ঘমেয়াদি ক্যাম্পেইন চালাতে পারে ভারত।
দৃশ্যত, মোদির ভারত সে পথেই হাঁটছে। কাশ্মীর ইস্যুর ঢাল হিসেবে জাতিসংঘে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রসঙ্গ তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। যদিও এ কৌশল কতটা কাজের তা নিয়ে বিতর্ক আছে ভারতের বিশেষজ্ঞদের মাঝে। এদিকে সর্বোচ্চ পদমর্যাদার প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের একটি বৈঠকে মোদি উরি হামলায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ চেয়েছেন। জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ পরিষদ অধিবেশনসহ আন্তর্জাতিক ফোরামসমূহে এ প্রমাণ তুলে ধরতে চান তিনি।
অপরদিকে পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় দেশটির সাবেক তিন পররাষ্ট্র সচিব ও এক জাতীয় নিয়াপত্তা উপদেষ্টা পাকিস্তানের করণীয় সমপর্কে একটি যৌথ কলাম লিখেছেন। ‘রেস্পন্ডিং টু অ্যা ডেনজেরাস টাইম’ শীর্ষক ওই কলামে তারা ভারত ও আফগানিস্তানের হুমকি এবং ওয়াশিংটনে পাকিস্তান-বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। তারা পাকিস্তান সরকারকে তালিবান নীতি পুনর্বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি পাক সেনাবাহিনীর তালিবান-বিরোধী অভিযানকে ঘিরে বিতর্ক অবসানের লক্ষ্যে কাজ করার তাগিদও ছিল তাদের কলামে। তাদের যুক্তি, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট করা, তাদের বিরুদ্ধে বিচার বেগবান করা, কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাদের ওপর হামলার তদন্ত শুরু করা, ইত্যাদি যদি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ সাধারণ পরিষদসহ বৈশ্বিক ফোরামে স্পষ্ট করেন, তাহলে ওয়াশিংটন ও বিশ্ব সমপ্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরো স্বাভাবিক হবে। তারা লিখেছেন, এ কঠিন সময়ে চীন ও মুসলিম বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলোর সহায়তার ওপর নির্ভর করতে পারে পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানকে আরো বেশি নির্ভর করতে হবে নিজেদের কূটনৈতিক সক্রিয়তা বাড়ানো ও সঠিক নীতিমালা প্রণয়নের ওপর।
দৃশ্যত, নওয়াজ শরীফ ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশটিতে ক্রমেই পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে। রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস কয়েক দিন আগে পাকিস্তানের কাছে মার্কিন বিমান বিক্রয়ের সরকারি চুক্তি বাতিল করে। সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন নওয়াজ। সেখানে তিনি কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নৃশংসতা তুলে ধরেছেন। তিনি কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিশ্রুতির কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
পাকিস্তান এ কূটনৈতিক লড়াইয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনকে পাশে পেতে পারে। এছাড়া মুসলিম দেশগুলোর সমর্থনও পেতে পারে দেশটি। ইতিমধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর জোট ওআইসি এক বিবৃতিতে দৃশ্যত পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কাশ্মীর সমস্যা গণভোটের মাধ্যমে সমাধানের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবনা ভারত মানতে রাজি না হওয়ায় খেদ প্রকাশ করা হয় বিবৃতিতে।
তাই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন তো বটেই। তবে সামরিক নয়, কূটনৈতিক যুদ্ধ।

পাঠকের মতামত: