ছোটন কান্তি নাথ, কুতুপালং শরণার্থী শিবির থেকে ::
কক্সবাজার–টেকনাফ মহাসড়কের পাশে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালীতে এক হাজার ৫শ একর বনভূমি জুড়ে স্থাপন করা হচ্ছে একটি রোহিঙ্গা শিবির। কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের এই জমিতে শিবিরটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই শিবিরে সম্প্রতি পালিয়ে আসা সকল রোহিঙ্গাকে জড়ো করে রাখা হবে। রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাভাবিক জীবন–যাপনের সুযোগ–সুবিধাদিও দেওয়া হবে। সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন দৈনিক আজাদীকে জানান, এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে ল্যাট্রিন এবং সুপেয় পানির জন্য পর্যাপ্ত নলকূপসহ সব ব্যবস্থা থাকবে। জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আশা করছি এই জায়গায় স্থাপন হওয়া রোহিঙ্গা শিবিরে সংকুলান হয়ে যাবে কয়েকদিনে আগত রোহিঙ্গাদের। রাস্তাঘাটে যেভাবে রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে সে কারণে সকল পক্ষের দুর্ভোগ বেড়েছে। তাদের সরানোর কাজ সম্পন্ন হলে কক্সবাজার–টেকনাফ মহাসড়কটিও উন্মুক্ত হয়ে যাবে এবং যানবাহন চলাচলে আর সমস্যা দেখা দেবে না। এই লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা বর্তমানে উখিয়ায় অবস্থান করছেন।’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে নতুন এই রোহিঙ্গা শিবির তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে থাকবে প্রয়োজনীয় সকল সুবিধা। ইতিমধ্যে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সম্ভাব্য রোহিঙ্গা শিবিরস্থল পরিদর্শন করে সেখানে কাজ শুরু করার নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।’ তিনি আরো জানান, এ শিবিরে যাদের স্থান হবে তাদেরকে রোহিঙ্গা নাগরিক হিসেবে পরিচয় পত্র দেওয়া হবে। পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা এবং তারা যাতে শিবির ছেড়ে বাইরে এসে আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে সে জন্য সার্বক্ষণিক পুলিশী প্রহরা থাকবে।
বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগ : এদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের নৃসংশতার মুখে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে আসা নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ রোহিঙ্গারা নাফ নদী পেরিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেও এপারে এসে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন তারা। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কোলের শিশু, নারী, বৃদ্ধদের দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। এসব রোহিঙ্গার কেউ কক্সবাজার–টেকনাফ মহাসড়ক তথা শহীদ এটিএম জাফর আলম সড়কের ধারে, পাহাড়ের টিলা ও পাদদেশে, জমির আইলের ধারে এখানে–ওখানে অবস্থান নিলেও তাদের অনেকের মাথার ওপর নেই কোন ছাউনি। এই অবস্থায় বৃষ্টি তাদের দুর্ভোগ যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ওপর বিশুদ্ধ পানি, খাবার এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রাদির সংকট রয়েছে। পয়ঃ নিষ্কাশনের কোন সুযোগ না থাকায় পরিবেশ বিষিয়ে উঠছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, প্রশাসন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে কাজ শুরু করে দিয়েছে গতকাল রবিবার সকাল থেকে। এই লক্ষ্যে শনিবার রাতে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। রোহিঙ্গা সংকটের এই পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসক আলী হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় সরকারী সকল দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয় সড়ক, পাহাড়সহ বিভিন্নস্থানে যত্রতত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা এসব রোহিঙ্গাকে নির্দিষ্ট স্থানে সরিয়ে নেওয়ার। তাছাড়া বর্তমানে যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে যে কেউ এসে রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করছেন সেখানে হুলস্থুল কান্ডসহ নানা ধরণের পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। তাই এখন থেকে কেউ ব্যক্তিগত বা সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে সরাসরি কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে জেলা প্রশাসনের খোলা তদারক (কন্ট্রোল) রুমে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে সেসব ত্রাণ জমা দিতে হবে। পরে এসব ত্রাণ যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করবে প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম :
গত কয়েকদিন ধরে কক্সবাজার–টেকনাফ মহাসড়কের প্রায় ৩৫ কিলোমিটারের দুই পাশ এবং বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা খাদ্য সংকটসহ নানা সমস্যায় থাকায় তাদেরকে বিভিন্নস্থান থেকে ব্যক্তিগতভাবে এবং বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছিল। কিন্তু এই ত্রাণ বিতরণের সময় একসঙ্গে বেশি সংখ্যক মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ায় দাতারাও ত্রাণ দিতে গিয়ে নানা বিড়ম্বণার শিকার হচ্ছেন। এমনকি এই ত্রাণ সমবন্টন হারে প্রত্যেকের হাতেও না পৌঁছার অভিযোগ উঠছে। তাছাড়া ত্রাণ বিতরণের নামে অনেক ছদ্মবেশী ও ভূঁইফোঁড় সংগঠন কিঞ্চিত ত্রাণ দিয়ে ফটোসেশন করছিলেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে নিষিদ্ধ কোন সংগঠন ত্রাণ তৎপরতার আড়ালে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন কী–না তা দেখাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি বিভিন্নস্থান থেকে সরাসরি সড়কের ওপর এসে যানবাহন থেকে এই ত্রাণ বিতরণ করতে শুরু করায় ব্যস্ততম এই মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, ‘সড়কের দুই ধারে এবং বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের মাঝে এখন থেকে আর যত্রতত্রভাবে ত্রাণ বিতরণ করা যাবে না। এভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে গেলে অনেকে পায় আবার অনেকে না পাওয়ার কথা উঠছে। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ইতিমধ্যে খোলা কন্ট্রোল রুমে ত্রাণ সামগ্রী জমা দিতে হবে আগ্রহীদের। এর পর প্রশাসনের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের মাঝে যথাযথভাবে এই ত্রাণ বন্টন করবে। অপরদিকে ১০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খিঁচুড়ি রান্না করে খাওয়ানো হয়েছে।
নির্মাণ সামগ্রীর অপ্রতুলতা ও কয়েকগুণ দাম : এপারে আসা রোহিঙ্গারা পানি, খাবার, বাসস্থান সংকটে ভুগছেন বেশি। খোলা আকাশের নিচে দিনের বেলায় যেমন–তেমন হলেও অনেককে রাতের বেলায় ভুতুড়ে পরিবেশে সময় পার করতে হচ্ছে। এ কারণে শত শত রোহিঙ্গা মাথা গোঁজার ঠাই পেতে এখানে–ওখানেও ছুটছেন নির্মাণ সামগ্রী সংগ্রহ করতে। আর এ সুযোগে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে নির্মাণসামগ্রী তথা বাঁশ, গাছ, বেত, সুঁতা, প্লাস্টিকের সুঁতলীর দাম। একটি বাঁশ আগে যেখানে ৫০ বা ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, সেই বাঁশ এখন দুই থেকে তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা থাকায় স্থানীয় অনেকে এই ব্যবসায়ও নেমে পড়েছেন। তারা বান্দরবানের লামা, আলীকদম ও কক্সবাজারের চকরিয়া, ঈদগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঁশ–গাছ সংগ্রহ করে গাড়িযোগে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করছেন। আবার রোহিঙ্গারাও পাহাড়ে বস্তির মতো ঝুঁপড়িঘর নির্মাণ করতে স্থানীয় লোকজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দা, কুড়াল, খন্তা, কোদালসহ বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করছেন।
উখিয়া টেকনাফে কমমূল্যে মিলছে গরু মহিষের মাংস : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির সিংহভাগই কৃষিকাজের পাশাপাশি গবাদি পশু লালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পালিয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গা তাদের গরু, মহিষ সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন। আর সীমান্ত পার হওয়ার পর এসব গবাদি পশু এখানকার কিছু লোকজন নামমাত্র মূল্যে বা ভয়–ভীতি দেখিয়ে ছিনিয়ে নিচ্ছেন। ফলে যে গরু ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা সেই গরুর মিলছে ২০ থেকে ২৫ হাজারে। এতে গবাদি পশুর মাংসের দামও এখানে অবিশ্বাস্যভাবে কমে গেছে।
গতকাল বিকেলে উখিয়া উপজেলার থাইংখালী বাজারের কসাই নুরুল হক তার মাংসের দোকানে মাইক লাগিয়েছেন। নুরুল হক মাইকে ঘোষণা করছিলেন, ‘মহিষের মাংস এক কেজি নিলে ৩০০ টাকা আর দুই কেজি নিলে ৫০০ টাকা। আবার গরুর মাংসও প্রতিকেজি মিলছে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকার মধ্যে।
অবিশ্বাস্য কমমূল্যে মাংস বিক্রির কারণ জানতে চাইলে নুরুল হক বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আসার সময় গবাদি পশুও নিয়ে আসছেন। আর আমরাও অর্ধেক মূল্যে সেই গবাদি পশু ক্রয় করে মাংস বিক্রি করছি। এ কারণে বর্তমানে মাংসের দাম কমে গেছে।
তিন রোহিঙ্গা কিশোরীকে অপহরণের চেষ্টা : মিয়ানমারের মংডু জেলার বাঘঘোনা এলাকার মোহাম্মদ ইয়াছিন শনিবার রাতে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে এপারে পৌঁছেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিল স্ত্রী ও তিন কন্যা ছকিনা, খালেদা ও রশিদা। স্ত্রী ও তিন কিশোরী কন্যাকে নিয়ে গতকাল রবিবার বিকেলে উখিয়ার বালুখালী আসছিলেন গাড়িযোগে। এখানে এসে গাড়ি থেকে নামার সময় বেশি ভাড়া দাবি করায় গাড়ির সহকারীর সঙ্গে বাদানুবাদ শুরু হয়। এই মুহূর্তে স্থানীয় কিছু বখাটে যুবক এসে রোহিঙ্গা ইয়াছিনের কাছ থেকে তিন কিশোরীকে নিয়ে একটি পিকআপে উঠে যায়। তখন সেখানে কক্সাবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা জসীম উদ্দিনের পক্ষে ত্রাণ বিতরণের জন্য আসেন তিন যুবক টিপু, ফয়সাল ও আবদুল্লাহ। এই তিন যুবক রোহিঙ্গা ইয়াছিনের তিন কিশোরী কন্যাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা জানতে পেরে তাদেরকে উদ্ধারে এগিয়ে গেলে স্থানীয় বখাটে–সন্ত্রাসীরা ত্রাণ দিতে আসা তিন যুবককে শারিরিকভাবে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে পুলিশ ও স্থানীয় আরো লোকজন এগিয়ে গেলে বখাটে–সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যাওয়ায় নিশ্চিত অপহরণ থেকে রক্ষা পায় তিন রোহিঙ্গা কিশোরী।
পাঠকের মতামত: