ঢাকা,সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে মা-বাবা হারানো বাচ্চা হাতি ‘আইরিন’ বেড়ে উঠছে পরম মমতায়

এম রায়হান চৌধুরী চকরিয় ::

খুব অল্প বয়সে টেকনাফের বনাঞ্চলে বিচরণরত অবস্থায় মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা করে মিয়ানমারে পাচারের সময় সংঘবদ্ধ বন্যপ্রাণি পাচারকারী চক্র নাফ নদীর লবণ পানিতে ফেলে দেয় বাচ্চা হাতি ‘আইরিন’কে। এ সময় টহলে থাকা বিজিবি সদস্যরা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বাচ্চা হাতিটিকে উদ্ধার করে। কিন্তু লবণ পানিতে হাবুডুবু খাওয়া ও পাচারকারীদের ধস্তাধস্তিতে আইরিনের সামনের ডান পা অঁকেজো হয়ে পড়লে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাতিটিকে বনবিভাগের মাধ্যমে বিজিবি পাঠিয়ে দেয় কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। এই পার্কে আসার পর মায়ের মমতা পেয়ে দিন দিন বেড়ে ওঠছে বাচ্চা হাতি আইরিন। বলতে গেলে এখন পুরোপুরি সুস্থ ও সবল হয়ে ওঠেছে এই বাচ্চা হাতি। দৈনিক ৪০ লিটার দুধ, সাথে ৫টি কলাগাছের শাস (ফাইবার) ও নারিকেলের জুস খাইয়ে বড় করে তোলা হচ্ছে পার্কের বন্যপ্রাণি হাসপাতালের কোয়ারেন্টাইন শেডে। পার্কে আগত দেশী-বিদেশী দর্শনার্থীদেরও আকৃষ্ট করছে এই বাচ্চা হাতিটি।

পার্ক সূত্র জানায়, বাচ্চা হাতিটির বর্তমান বয়স ৪ বছর ২ মাস হয়েছে মাত্র। ওজন দাঁড়িয়েছে ৪০০ কেজিতে। প্রায় এক বছরের এই বাচ্চা হাতিটি ২০১৫ সালের ২ মার্চ সংঘবদ্ধ বন্যপ্রাণি পাচারকারী চক্র পাচারের উদ্দেশ্যে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় তুলে নিয়ে মিয়ানমারের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় নদীতে বিজিবি সদস্যরা টহল দেওয়ার সময় পাচারকারীরা ধরা পড়ার আগেই টেকনাফের নাফ নদীর লবণাক্ত পানিতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায়। তখন সাঁতার না জানা বাচ্চা হাতিটি পানিতে হাবুডুবু খেতে দেখে বিজিবি সদস্যরা হাতিটিকে উদ্ধার করে। পরে টেকনাফ ৪২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল আবুজার আল জাহিদ বাচ্চা হাতিটিকে টেকনাফ বনবিভাগে নিয়ে যায়। সামনের ডান পা পুরোপুরি অঁকেজো অবস্থায় পরদিন ৩ মার্চ বাচ্চা হাতিটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয় চকরিয়ার ডুলাহাজারাস্থ বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে।

সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণি হাসপাতালের সহকারী ভেটেরিনারী সার্জন মো. মোস্তাফিজুর রহমান আামাদের র্অথনিতীকে বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য যখন বাচ্চা হাতিটিকে পার্কের বন্যপ্রাণি হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় তখন সামনের ডান পা পুরোপুরি অঁকেজো ছিল। তাছাড়া লবণাক্ত পানিতে হাবুডুবু খাওয়ার কারণে হাতিটির চোখ দুটিতেও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অঝোর ধারায় পানি ঝরছিল দুই চোখ বেয়ে। এই অবস্থায় হাতিটিকে সুস্থ করে তুলতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া শুরু করি।’

বন্যপ্রাণি চিকিৎসক মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, ‘১০০ কেজি ওজনের প্রায় এক বছর বয়সী এই বাচ্চা হাতিটিকে পার্কের হাসপাতালে প্রেরণের পর কয়েকমাস দৈনিক ১৫ লিটার দুধ ও হালকা সবুজ ঘাস খাওয়ানো হতো। এর পর বয়স বাড়তে থাকলে পর্যায়ক্রমে খাবারের পরিমাণও বাড়তে থাকে। বর্তমানে দুই বেলায় দৈনিক ৪০ লিটার দুধ, ৫টি কলা গাছের শাস (ফাইবার), নারিকেলের জুসের পাশাপাশি নিয়মিত ভিটামিন সিরাপ, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ও এমাইনো এসিডের সিরাপ খাওয়ানো হচ্ছে। এতে এখন পুরোপুরি সুস্থ ও সবল হয়ে ওঠেছে এই হাতিটি। বর্তমানে হাতিটির ওজন দাঁড়িয়েছে ৪০০ কেজিতে।

বাচ্চা হাতিটিকে মায়ের মমতায় পরিচর্যার দায়িত্ব পেয়েছেন মাহুত সত্যজিৎ চাকমা। তিনি বলেন, ‘এই বাচ্চা হাতির পেছনেই সার্বক্ষণিক আমার তীক্ষè দৃষ্টি রয়েছে। দিনের বেলায় হাসপাতালের কোয়ারেন্টাইন শেডে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করলেও রাতের বেলায় নির্দিষ্ট একটি রুমে রাখা হয় হাতিটিকে। মশার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে মশারীও টাঙিয়ে দেওয়া হয়। এর পাশের রুমেই ঘুমাই আমি।’

মাহুত সত্যজিৎ আরো বলেন, ‘খুব অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে শোকে কাতর হয়ে পড়েছিল এই বাচ্চা হাতিটি। পার্কে আনার পর থেকেই হাতিটি আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠে। আমিও তাকে মায়ের মমতার পূর্ণতা দিয়ে দিনের পর দিন বড় করে তুলছি। যখনই আমি তার কাছ থেকে একটু দূরে যাওয়ার চেষ্টা করি তখন চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দেয়।’

সাফারি পার্কের বিট কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বন্যপ্রাণি পাচারকারীর খপ্পড় থেকে উদ্ধারের পর এই বাচ্চা হাতিটিকে চিকিৎসা ও লালন-পালনের জন্য পার্কে প্রেরণ করেন টেকনাফ ৪২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল আবুজার আল জাহিদ। সম্প্রতি পরিবার সদস্যদের নিয়ে তিনি দেখেও গেছেন বাচ্চা হাতিটিকে। এ সময় তিনি পার্কের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাধুবাদ জানান প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে হাতিটিকে ভাল করতে পারায়।

মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘বিজিবির এই কর্মকর্তার কন্যা সন্তান আইরিনের নামানুসারে তিনি হাতিটিরও নাম রেখে যান ‘আইরিন’। তখন থেকেই হাতিটিকে ‘আইরিন’ হিসেবে ডাকলেই সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে।’

বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের তত্ত্বাবধায়ক (রেঞ্জার) আামাদের র্অথনিতীকে

বলেন, ‘পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করা বাচ্চা হাতিটিকে উপযুক্ত চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা হয়েছে। এই বাচ্চা হাতিটিও পার্কে আগত দেশী-বিদেশী পর্যটকদের বেশ দৃষ্টি কাঁড়ছে। পর্যটকেরাও যাতে বাইরে থেকে বাচ্চা হাতিটিকে ভাল করে দেখতে পায় সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ ##

পাঠকের মতামত: