স্মার্টফোনের এই যুগে মানুষের নিত্যসঙ্গি হলো ফেসবুক। নিত্যদিনের শত ব্যস্ততার ফাঁকে ফেসবুক নোটিফিকেশনে প্রত্যেকে ঠিকই পলক বুলিয়ে নেয়। অনেকে কর্মব্যস্ত সময়ে একটু রিফ্রেশমেন্টের জন্য ফেসবুকিং করে থাকেন। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশি তরুণপ্রজন্ম সামাজিক এই যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে বেশ এগিয়ে। পড়াশুনা বা চাকরি-ব্যবসার পাশাপাশি ফেসবুকের ক্ষণিক ব্যবহারকে কিছুতেই দোষের বা সময় নষ্ট বলা চলেনা, বরং ক্লান্তির ছাপ কাটিয়ে উঠতে ফেসবুক বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখে। কিন্তু যখন ফেসবুকই কারো প্রধানতম কাজ হয়ে দাঁড়ায়, তখন ঘটে যত বিপত্তি। তাই নিজের কাজকে অবহেলা করে নয়, বরং কাজের সাথে কিংবা কাজের ফাঁকে কর্মউদ্দিপক কিছুটা বিনোদনের দরকার অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কেবল কাজ, কাজ আর কাজের ভিড়ে থাকলে, জীবনটা যান্ত্রিকতায় হিমশিম খাবে। আর যখন সৃজনশীল ও শৈল্পিক প্রচেষ্টায় জীবনের স্বাদ গ্রহণের তথা জীবনকে অভিবাদনের মানসিকতা তৈরি হবে, তখনই কবি তারাশঙ্করের মতো বলতে হচ্ছে হবে, ‘জীবন এতো ছোট কেন?’
এখন ফেসবুকের মাধ্যমে তরুণ-যুবারা বেশকিছু জনকল্যাণমূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন- মূমুর্ষূ রোগিদের জন্য প্রযোজনীয় রক্ত সরবরাহের সুব্যবস্থা, ঠোঁটকাটা রোগিদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধার প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী, এছাড়া খুন-ধর্ষন ও হয়রানির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানিয়ে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়। ব্যক্তিগত প্রোফাইল একাউন্টের পাশাপাশি দলীয় বা সমিতি আকারে বিভিন্ন ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে শিক্ষণীয় ও আধুনিকমনস্ক প্রচারণা লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে অনেক ফেসবুক একাউন্ট থেকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরব থেকে জঙ্গিদের নির্মূলে নানান পদক্ষেপ এবং জনসাধারণের প্রতি সচেতনতামূলক পোস্ট আহ্বান করা হয়। বিভিন্ন ইস্যুতে ফেসবুকের রকমারি ব্যবহার আমাদেরকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অবগত করেন। এভাবেই ফেসবুক হয়ে উঠে নিজেদের অভিমত ও মতামত প্রকাশের নিত্যদিনের সঙ্গি। ফেসবুকীয় জীবনে ব্যক্তি তার ভাব-আবেগ-অনুভূতির বিভিন্নমাত্রায় প্রকাশের সুযোগ থাকে। পাশাপাশি অপরের ফেসবুকীয় জীবন সম্পর্কে মতামত বা সহমর্মিতা ব্যক্ত করতে পারে।
গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়গুলো সম্পর্কে অনেকে উদাসীন থাকলেও ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ধীরে ধীরে অনলাইনের মতো তাদের ব্যক্তিগত জীবনেও গোপনীয়তা রক্ষা করে চলার প্রয়োজন অনুভব করতে শিখে। এছাড়া কথা-কাজ ও রুচিবোধের নিত্যচর্চা ফেসবুকের মাধ্যমে হতে পারে আরো সুসংহত। ফেসবুকে পোস্ট, শেয়ার ও কমেন্টে ব্যবহারকারীর জীবনবোধ সম্পর্কে অপরাপর বন্ধুগণ বা পারস্পরিক ব্যক্তিবর্গ জানতে পারে। তাই প্রায় সকলে খুব সতর্কতার সাথে আচরণ করতে শেখে। অনেকের জীবনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক’র সরাসরি বেশ ইতিবাচক ও সৃজনশীল প্রভাব তার জীবনটাকে নতুন করে শুরু করতে সহায়তা করে। নিজের ভেতরকার মানুষটিকে নিজের মতো করে তুলে ধরার একটি সহজলভ্য ও আকর্ষনীয় মাধ্যম হলো ফেসবুক।
এতোক্ষণের আলোচনায় ফেসবুকের ইতিবাচক দিকগুলোর কথা তুলে ধরা হলেও কিছু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সতর্কতা জরুরি। যেমন- প্রতারণা করা বা প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি অনলাইনের জগতে খুবই স্বাভাবিক ও নিত্য ঘটনা হিসেবে বিবেচ্য। কারণ কোনো ধরনের জবাবদিহিতার কথা না ভেবেই অনেকে ইচ্ছেতাই তথা বেপরোয়াভাবে এই সামাজিক মাধ্যমটির অপব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু কিছু সময় নীরবে ভাবলে, আমাদের বুঝে আসবে কতিপয় ব্যক্তির দুর্বৃত্তপনায় অন্যান্য সবধরনের সুবিধাগুলোকে অস্বীকার করাটা অযৌক্তিক। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে এভাবে- কোনো নির্দিষ্ট স্থানের মানুষ খারাপ আচরণের হবে, তা ঠিক নয়। মানুষের জন্মস্থান দিয়ে নয় তাকে কর্মমূল্যায়নে ভূষিত করা দরকার। ঠিক তেমনি ফেসবুকের ইতিবাচক দিকটিকে বিবেচনা করে কতিপয়ের অসৌজন্য ও অপরাধমূলক কর্মকা-ের জন্য সকল ফেসবুক ব্যবহারকারীকে দোষী করার মানে হয়না।
ভালো বা খারাপের মান বিবেচনায় আমাদেরকে প্রথমেই নিজ নিজ সক্ষমতায় উত্তীর্ণ হতে হবে। মনে রাখতে হবে যন্ত্র নয়, মানুষই যাবতীয় প্রতারণায় প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাই নিজেদের দোষ যন্ত্রের কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার কোনো মানে হয়না। তাই আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য নিজেকে উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। তবে জীবনের প্রয়োজনে অনেককিছুই সাথে নিতে হয়, মানতে হয়। কিন্তু এতে করে জীবন যেনো কখনো বাদ পড়ে না যায়। অর্থাৎ জীবনকে আনন্দময় করতে বিভিন্ন উপকরণের দরকার পড়লেও কেবল উপকরণাদি দিয়ে চলার সুযোগ নেই। জীবন সে-তো সমহিমায় উজ্জ্বল। জীবনের বিবেচনায় জীবন-মৃত্যু ব্যতিত কিছুই তুলনীয় নয়।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
পাঠকের মতামত: