ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকায় ‘বস্তাভর্তি টাকা’ নিয়ে যায় সার্ভেয়াররা

কক্সবাজার প্রতিনিধি :: কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা যেন টাকার খনি। তাই যোগদানের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই টাকার কুমিরে পরিণত হয় একেকজন সার্ভেয়ার। তবে শুধু সার্ভেয়ার নয়, এই শাখায় দায়িত্বরত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলও), অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, কানুনগো এবং কর্মরচারীরাও দুর্নীতিতে পিছিয়ে নেই। এলএ শাখায় একবার চাকুরি করার সুযোগ হলে জীবনে আর তাকে পেছনে ফিরে থাকাতে হয়না বলে মন্তব্য জেলা প্রশাসনে কর্মরত কয়েকজন কর্মচারীর।
তাদের দাবী, ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি ভূমিকা থাকে সার্ভেয়ারের। সার্ভেয়ারের প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেন কি পাবেন না। তাই যোগদানের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই টাকার কুমিরে পরিণত হয় তারা।
জেলা প্রশাসনের একজন কর্মচারীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার কক্সবাজার থেকে টাকা পাচার করে সার্ভেয়ারেরা। সপ্তাহজুড়ে হাতিয়ে নেওয়া দুর্নীতির লাখ লাখ টাকা বিমানে করে নিয়ে যান তারা। ঢাকায় পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনের নামে করা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা রাখেন। ওই কর্মচারীর ভাষ্যমতে, সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে ঢাকায় যান তারা।
জেলা প্রশাসনের একজন কর্মচারী জানান, গত ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারী কালারমারছড়ার নয়াপাড়া এলাকার একটি রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত ১৩/১৮-১৯ মামলার ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের প্রায় ৪ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের চেক দেওয়া হয়। নিয়ম না মেনে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে চেক গুলো ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এলএ শাখার শীর্ষ দালাল কালারমারছড়া এলাকার মৃত ফজলুল করিমে ছেলে জালাল উদ্দিন, নুরুল ইসলাম বাহাদুর, জাফর আলম এবং মমতাজের মাধ্যমে চেকগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, শহরের বাহারছড়া এলাকার পিটিস্কুল সংলগ্ন আব্দুল হালিমের বাসার ৩য় তলার সার্ভেয়ার ফরিদের বাসা থেকে চেকগুলো বিতরণ করে সার্ভেয়ার ফরিদ ও ওয়াসিম (র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার)। চেকগুলো বিতরণ করার জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে সন্ধ্যায় জড়ো করা হয়। পরে সেখান থেকে চারজনের গ্রুপ করে সার্ভেয়ার ফরিদের বাসায় নিয়ে গিয়ে চেক বুঝিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেক চেক থেকে তারা আদায় করে নেয় মোট টাকার ৩০ শতাংশ কমিশন। কমিশনের ওই সকল চেক সোমবার ও মঙ্গলবার ক্যাশ করা হয়। এছাড়াও মাতারবাড়ির কয়লা বিদ্যুৎ এবং এসপিএম প্রজেক্টের ক্ষতিপূরণের কয়েকটি কমিশনের চেক ক্যাশ করে চলতি সপ্তাহে। সপ্তাহজুড়ে ক্যাশ করা দুর্নীতির টাকা বৃহস্পতিবার ঢাকায় নেওয়ার আগেই বুধবার ধরা পড়ে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সপ্তাহজুড়ে হাতিয়ে নেওয়া লাখ লাখ টাকা ঢাকায় পাচার করতে সহযোগিতা করে চিহ্নিত কিছু দালাল। টাকা বেশি হলে কয়েক ব্যাগে ভাগ করে সার্ভেয়ারদের সাথে ২/৩ জন দালালও প্রতি বৃহস্পতিবার বিমানে করে ঢাকা যান। এছাড়াও এসএ পরিবহন এবং নিজেদের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমেও সার্ভেয়ারদের টাকা ঢাকায় পাচারে সহযোগিতা করে দালালেরা।
সার্ভেয়ার ওয়াসিম গ্রেপ্তারের পর সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে চরম আতঙ্কে রয়েছে এলএ শাখার দালালেরা। শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত দালালদের অফিসগুলোতেও অভিযানের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কেউ কেউ গা ঢাকা দিয়েছে বাঁচার জন্য। আর জেলা প্রশাসনের এলএ শাখায় বিরাজ করছে সুনশান নিরবতা।
অন্যান্যরা অফিসে আসলেও সার্ভেয়ার ফেরদৌস ও ফরিদ গতকাল বৃহস্পতিবার অফিসে যাননি। যেসব সার্ভেয়ার অফিস করেছেন তাদের চোখেমুখেও আতঙ্কের ছাপ দেখা গেছে। সার্ভেয়ারদের পাশাপাশি কানুনগো ও ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তারাও সারাদিন বেশ আতঙ্কে পার করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রত্যেক সার্ভেয়ার বৃহস্পতিবার ঢাকায় পাচারের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা জমা করে। কিন্তু হঠাৎ র‌্যাবের অভিযানে চলতি বৃহস্পতিবারে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বাসায় অভিযানের ভয়ে দুর্নীতির লাখ লাখ টাকা দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছে। দালালেরা তাদের নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে জমা করছে। কোন কোন দালাল নিজের বাড়িতেও জমা রাখছে সার্ভেয়ারের টাকার বস্তা।
বৃহস্পতিবার সার্ভেয়ার রাসেল, কবির, জাহাঙ্গীরসহ আরও কয়েকজন সার্ভেয়ারের টাকা ব্যাংকে কয়েক দফায় জমা করেছেন শীর্ষ দালাল কালারমারছড়া আধারঘোনা এলাকার আমান উল্লাহ ও একই এলাকার আব্দুল হান্নান। তারা বৃহস্পতিবার দুপুরে মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংকে তাদের নিজস্ব হিসাবে টাকা জমা রাখে। এছাড়া আরও কয়েকজন দালালের মাধ্যমে সার্ভেয়ারেরা বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা জমা করেছে বৃহস্পতিবার।
বৃহস্পতিবার শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত দালালদের অফিস সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। দালালদের এসব অফিস যেন একেকটি এলএ শাখা। হোটেল ইডেন গার্ডেনের নিচতলায় রয়েছে বাবুল হোসাইন রনি নামে এক দালালের অফিস। তাঁর অফিসে আরও বসে ভেন্ডার রফিক, আমান, মমতাজসহ বেশ কয়েকজন। হোটেল গার্ডেনে রয়েছে মাতারবাড়ির শীর্ষ দালাল আমানের অফিস। এমএস গেস্ট কেয়ারের ২য় তলা ও ৪র্থ তলায় এবং সৈকত পেপার এজেন্সির পেছনে অফিস রয়েছে শীর্ষ দালাল সঞ্জয়ের। সঞ্জয় নকল দলিল ও নকল এসেসমেন্ট তৈরীর মূল কারিগর। সঞ্জয়ের ভূয়া দলিল ও এসেসমেন্টের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছে শত শত ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক। সঞ্জয় হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
বার্মিজ মার্কেট এলাকার বানু প্লাজায় রয়েছে আরেক শীর্ষ দালাল রফিকের অফিস। কলাতলীর মোড়ের একটি নির্মাণাধীন ভবনেও দালালদের একটি অফিস রয়েছে। এই অফিসে ১৫ থেকে ২০ জন দালালের আনাগোনা থাকে নিয়মিত। এরমধ্যে সাইফুল শীর্ষে রয়েছে।
এলএ শাখার অন্যতম শীর্ষ দালাল জালাল উদ্দিন চক্র। এই চক্রে নেতৃত্ব দেন কালারমারছড়ার মৃত ফজলুল করিমের ছেলে জালাল উদ্দিন, মৃত হোছন আলীর ছেলে নুরুল ইসলাম বাহাদুর, মৃত নুরুল হুদার ছেলে জাফর আলম, মৃত হোসেনের ছেলে মমতাজ। এ চারজন বাইরে কাজ করলেও তাদের হয়ে এলএ শাখায় কাজ করে হোয়ানকের আমান। তাদের অফিস হোটেল গার্ডেনে।
শীর্ষ দালালদের মধ্যে এলএ অফিসে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি তৎপরতা রয়েছে শাপলাপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদ সেলিম, হোয়ানকের ইব্রাহিম (হোটেল গার্ডেনে অফিস), মাতারবাড়ির হেলাল, শাপলাপুরের দিদার (হোটেল নিরিবিলিতে অফিস), মাতারবাড়ির বাবর চৌধুরী, কালারমারছড়া ইউনিয়নের আব্দুল হান্নান, একই এলাকার আমান উল্লাহ, কালারমারছড়ার নুনাছড়ি এলাকার লকিয়ত উল্লাহ, মাতারবাড়ির হোছাইন (অফিস হোটেল নিরিবিলি), ধলঘাটা ইউনিয়নের তাজ উদ্দিন (হোটেল সৈয়দিয়ায় অফিস), পেশকারপাড়া এলাকার মো. মুবিন ওরফে উত্তরবঙ্গের মুবিন, মাতারবাড়ি ইউনিয়নের সাগর, ঈদগাঁও এলাকার মো. তৈয়ব, রশিদ নগর ইউনিয়নের মো. শাহজাহান, ঘোনারপাড়ার আলমগীর টাওয়ারের মালিক আলমগীর, ধলঘাটার মো. শফিউল আলম, শহরের কলাতলী এলাকার সাজ্জাদ প্রমুখ।
ভুক্তভোগী কয়েকজন জমির মালিক জানান, এলএ শাখার দালালেরা প্রায় চিহ্নিত। কিন্তু প্রশাসন এখন পর্যন্ত দালালদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। চিহ্নিত দালালদের গ্রেপ্তারে র‌্যাবের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার বলেন, দালাল বিতাড়িত করতে জেলা প্রশাসন সব সময় কঠোর অবস্থানে আছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার দালাল আটক করে জেল-জরিমানাও করা হয়েছিল। এখন র‌্যাব যদি আমাদের কাছ থেকে সহযোগিতা চায় বা আমাদেরকে সহযোগিতা করে তাহলে দুর্নীতিতে জড়িত অফিসের স্টাফ এবং দালালদের আইনের আওতায় আনতে সহজ হবে।
র‌্যাব-১৫ এর পরিচালক লে. কর্ণেল আজিম আহমেদ বৃহস্পতিবার প্রেস ব্রিফিংয়ে দালালদের বিষয়ে বলেন, সার্ভেয়ার ওয়াসিম, ফরিদ ও ফেরদৌসের বাসায় অভিযানের সময় বেশকিছু ডকুমেন্ট উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে দালাল চক্রের সদস্যদের নামও পাওয়া গেছে। এলএ শাখায় দুর্নীতিতে জড়িত দালালদের বিষয়ে আরও তথ্য-উপাত্ত নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু সংখ্যককে চিহ্নিতও করা হয়েছে। শিগগিরই তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। তাছাড়া টাকা উদ্ধারের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্তেও দালাল চক্রের নাম বেরিয়ে আসবে।

পাঠকের মতামত: