ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

পেকুয়ার দুইটি অবৈধ ইটভাটায় পুড়ছে বনের কাঠ!

মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া ::
কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটারের দুরত্বে স্থাপিত অবৈধ দুইটি ইটভাটায় বনের বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরীর অভিযোগ উঠেছে। নিয়ম না মেনে বনের পাশে ও ফসলি জমির মাঝখানে ইটভাটা স্থাপন করে একদিকে যেমন বনের কাঠ পুড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি করছে, অপরদিকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে ইটভাটার পাশের কয়েকটি গ্রামের ১০ হাজার মানুষ। জানা যায়, পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া ইউনিয়নের পাহাড়িয়াখালী গ্রামে ফসলি জমিতে ও বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটার দূরত্বে স্থানীয় মোস্তাক আহমদ, জয়নাল ও শোয়াইবুল ইসলাম নামের তিন ব্যক্তি এবং টইটং ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামে আহমদ নবী কোম্পানি অবৈধভাবে ইটভাটা স্থাপন করে দেদারসে বনের কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরী অব্যাহত রাখলেও বন বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর রহস্যজনক কারণে কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছেনা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন উদীসনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় পরিবেশ কর্মীরা।
আজ ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ইংরেজী বিকালে অবৈধ দুই ইটভাটা সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার কথা কয়লা। কিন্তু লোক দেখানো কিছু কয়লা ভাটার পাশে রাখা হলেও এর আড়ালে ওই তিন ব্যক্তির মালিকানাধীন অবৈধ ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ। বিপুল পরিমাণ কাঠ ভাটার আশেপাশে এনে মজুদ করে রাখা হয়েছে। আর এসব কাঠ রাতের আঁধারে ইট তৈরীর চুল্লিতে দেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, পেকুয়া উপজেলায় ২টি অবৈধ ইটভাটায় চলতি মৌসুমে ইট তৈরিতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। যা আইনত নিষিদ্ধ। টইটং ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামে ফসলি জমির পাশে অবৈধভাবে স্থাপিত আহমদ নবী কোম্পানির ইটভাটায়ও রাতের আঁধারে কাঠ এনে ভাটায় জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনায় সরকারি নির্দেশনা মানছেন না পেকুয়ার ওই দুইটি অবৈধ ইটভাটায়।
কক্সবাজার জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পেকুয়ায় একটিও নিবন্ধিত ইটভাটা নাই। কোন ইট ভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নাই। আর এসব ভাটায় প্রকাশ্যে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে।
জানা যায়, ১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত-২০১৩) অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চল, আবাদি জমি ও জনবসতিপূর্ণ এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন এবং ইট পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও পেকুয়ার বারবাকিয়ার পাহাড়িয়াখালী এবং টইটং ইউনিয়নের নাপিতখারী গ্রামে এলাকায় আবাদি জমির মাঝখানে ইটভাটা নির্মাণে আইনের কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কোনো ছাড়পত্রও নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পেকুয়ার বারবাকিয়া ও টইটংয়ের নাপিতখালীতে অবৈধভাবে স্থাপিত দুইটি ইটভাটার আশপাশে ফসলি জমিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফসল আবাদ। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় বাতাসে বেড়েই চলেছে বিষাক্ত কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাস। সেই সঙ্গে ধুলাবালির কারণে ক্ষেতের ফসল উৎপাদনে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। দিনরাত ধরে মাটি ও ইট আনা নেয়া করায় গ্রামের রাস্তাগুলো ভেঙে গেছে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩-তে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ইটভাটায় ফসলি জমির উপরের মাটি ব্যবহার করলে তার শাস্তি দুই বছর কারাদন্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানা। ওই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে শাস্তি ২ থেকে ১০ বছরের জেল এবং ২ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা।
সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কয়লার দাম বাড়তি হওয়ায় ওই দুইটি ইট ভাটার মালিকরা রাতের আঁধারে বনের কাঠ এনে ভাটায় ইট তৈরীর কাজে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করছে।
পেকুয়ার পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী মাহমুদুল করিম জানান, প্রতি ভাটায় ইট পোড়াতে দিনরাতে সাত থেকে আট মেট্রিক টন কাঠের প্রয়োজন হয়। এসব কাঠের জোগান অধিকাংশই পাশ্ববর্তী আসে বন থেকে। অথচ আইন অনুযায়ী জ্বালানি কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরপরও অবাধে চলছে এ কাজ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো ভাটার মালিকরা কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো ওই দুইটি ভাটার দূরত্ব বারবাকিয়া রেঞ্জ ও টইটং বন বিট অফিস থেকে ১-২ কিলোমিটারের মধ্যে। তবুও কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে অবগত নন বলে জানান বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক। তবে, তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান।
জানা যায়, বনাঞ্চলের তিন কিলোমিটার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন একেবারে নিষিদ্ধ। পেকুয়ার টইটং ও বারবাকিয়ায় এ দুইটি ইটভাটা স্থাপনে সে নিয়ম মানা হয়নি। ভাটায় কয়লার বদলে ইট পোড়ানো হয় কাঠ দিয়ে। এতে চাপ পড়ছে বনাঞ্চলের ওপর। পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হলেও ভাটার মালিকরা তা মানছেন না।
পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা: মোজাম্মেল হোছাইন চৌধুরী বলেন, নিয়ম না মেনে ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনার জন্য আশপাশের বসতি এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় ভাটার আশেপাশে গ্রামের বাসিন্দারা চোখ, ত্বক ও ফুসফুসের কঠিন রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

পাঠকের মতামত: