জসিম মাহমুদ, টেকনাফ :::
মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও হত্যার হাত থেতে রেহায় পাওয়া জন্য প্রাণে বাচঁতে তেলের জারিকেনের সহযোগিতায় সাঁতরিয়ে নাফনদী পাড়ি দেওয়ার সময় ১১ রোহিঙ্গা পুরুষকে উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফে শাহপরীর দ্বীপ জেটি সংলগ্ন নাফ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়।
মোহাম্মদ রিয়াজ (১২) বছর। বাবা কালা মিয়া, মা আমিনা খাতুন। তাদের বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুচিডং শহরের পুঁইমালি গ্রামে। বাবা কৃষিকাজ ও খেত খামার করে সংসার চালাতেন। পরিবারের একমাত্র ছেলে হলেও তার চারজন বোন মাহমুদা বেগম (২৮), এলম বাহার (২৬), নুর বেগম (১৮) ও কামরুন নাহার (৭)। তারমধ্যে বড় বোন মাহমুদা ও মেঝ বোন এলম বাহারের বিয়ে হয়েছে। কোরবানির চারদিন পর বড় বোনের স্বামী (নুর মোহাম্মদকে) বলিপাড়া তাদের বাড়ি থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। এসময় আরও অনন্ত ৩১ জনকে ধরে নিয়ে গেলেও তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর বড় বোন আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। মিয়ানমারের বুচিডং এলাকার বলিপাড়া, পুঁইমালিসহ বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের এক মাসের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের ঘর থেকেও বের হতে দিচ্ছিল না। এ কারণে গ্রামের খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়। তখন খাবারের অভাবে ওইসব গ্রামের বাসিন্দাদের মারা যাবার উপক্রম দেখা দেয়। খাবার আনার জন্য গ্রামের কয়েক লোক পাশ্ববর্তী গ্রামের বাজারের যাবার চেষ্টা করলে সেনা সদস্যরা এলোপাতারি গুলিবষণে মেঝ বোন এলম বাহারের স্বামী মো. আয়াসসহ ২১জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তখন তাদেরকে আল-ইয়াক্বিনের সদস্য বলে প্রচার করে সেনাবাহিনী।
গত এক সপ্তাহ আগে গ্রামে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে গ্রামগুলো খালী করে দেওয়া নির্দেশ দেন এবং বাবা কালা মিয়াসহ আরও প্রায় অর্ধশত লোকজনকে ধরে নিয়ে একটি পাহাড়ে পাদদেশে আটকে রেখে দেন। যাবার সময় আমাদের গ্রামের কয়েকটি বাড়িঘরের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন সেনাসদস্যরা।
এরপর তাদের বিনা খাবারে চারদিন ধরে বেঁেধ রেখে মারধর ও নিযার্তন করা হয়। তখন তাদের বলা হয় শুধু গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। পাঁচদিনের মাথায় শর্ত দিয়ে ছেড়ে দেন তাদের। শর্তটি ছিল গ্রাম ছেড়ে পালানোর। এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালানোর জন্য রাতের আধাঁরে প্যারাবনের ভিতর দিয়ে কোন রকমে মংডু শহরের ফাতংজা গ্রামে চলে আসি। কিন্তু সেখানে এসে দেখা গেলে তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষ জড়ো অবস্থায় রয়েছে। তারা নৌকা না থাকায় বাংলাদেশে পাড়ি দিতে পারছে না। সেখানে খাবারের জন্য হা হা কার করছে রোহিঙ্গারা।
তিনি আরও বলেন, জড়ো হওয়া লোকজনের মধ্যে আমরা ১১জন গতকাল বুধবার সকাল ৭টা সময় মিয়ানমার ফাতংজা থেকে শরীরের সঙ্গে জারিকেন বেঁধে সাঁতার কাটা শুরু করে সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জেটির কাছাকাছি চলে এলে কোস্টগার্ড সদস্যরা নাফনদী থেকে আমাদের উদ্ধার করে।
তারা হলো- বুচিডংয়ের পেরাংপুরু কামাল হোসেন (১৫), আনছার উল্লাহ (১৫) সিং ডংয়ের ফয়েজ উল্লাহ (১৭), ইসমাইলপাড়ার হামিদ হোসেন (১৩), হামজ্জাপাড়ার সৈয়দ হোসেন(৩০), তেরংপাড়ার আবদুল মতলব (৩০), হাইরমোরা পাড়ার মোহাম্মদ উল্লাহ (২৬), হাজুরীপাড়ার মোহাম্মদ আলম (১৮), পুইমালির মোহাম¥দ রিয়াজ (১২), ইমাম হোসেন (১৮) ও রমজান আলী (৩০)।
হামিদ হোছেন (১৫) বাবা পেঠান আলী, মা সেতেরা বেগম। তার বাড়ি মিয়ানমারের বুচিডং পেরাংপুরু গ্রামের। তিনি মংডু শহরের সিকদারপাড়া বাজারের একটি দরজির দোকানে মাসিক ৩৬ হাজার কিয়েটে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। তার বাবা পঙ্গু ছিলেন বিদায় পুরো সংসার চালাত তার আয়-রোজগারের উপর দিয়ে। হঠাৎ করে গত মাসে মংডু শহরের রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে ফেলে সেনা বাহিনী। চলাফিরা করতে দিচ্ছিল না রোহিঙ্গাদের। এ অবস্থায় দোকানে মালিকের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিস্তু মালিকের দোতলা কাঠের বাড়িটি যাতে না পুড়ানোর জন্য সেনাবাহিনীকে ৮০লাখ কিয়েট দিয়েছেন। বাজারের রোহিঙ্গাদের দোকানপাট বন্ধ এবং কোন রোহিঙ্গাকে বাজারে একা ফেলে গলা কেটে হত্যা করছে নতুবা মারধর করে ছেড়ে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকে রোহিঙ্গাদের উপর নিযার্তন। সেদেশের কোন সরকার নেই। আছে শুধু সেনাবাহিনী। তাদের কথাই সব কিছুই হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা অসহায়।
তিনি বলেন, পালানোর কোন সুযোগ না পাওয়াই মঙ্গলবার রাতে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে কোন রকমে নাফনদীর প্যারাবন দিয়ে ফাতংজা গ্রামে চলে আসি। এসে দেখি কোনো নৌকা নেই। আমার মতো আরও শত শত রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে পালানোর জন্য। তাই আমরা ১১জন নৌকা নেওয়ার জন্য জারিকেনের সহযোগিতায় সাঁতরিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ আসার চেষ্টা করি। আমাদের উদ্দ্যেশ্য ছিল নৌকা নিয়ে গিয়ে অপেক্ষামান রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসব। কিন্তু পারলাম না। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা মতো সাঁতরিয়ে আসার সময় তিন-চারজন অসুস্থ হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোস্টগার্ড শাহ পরীর দ্বীপ স্টেশন কমান্ডার লে. জাফর ইমাম সজীব বলেন, গতকাল সকাল ৯টা ৪৫মিনিটের দিকে নাফনদীতে হলুদ রংয়ের তেলের খালী জারিকেন নিয়ে কয়েকজন লোককে ভাসমান দেখে কোস্টর্গাড সদস্যরা তাদের সকাল ১০টা ৩৫মিনিটের দিকে উদ্ধার করে জেটিতে নিয়ে আসে। উদ্ধার করা রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার জন্য বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাত আটটা থেকে বুধবার সকাল আটটা পর্যন্ত টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রায় শতাধিক পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাকে সেনাবাহিনীর কাছে পাঠানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জারিকেনের সাহায্য নাফনদী সাঁতরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ রোহিঙ্গাকে কোস্টগার্ডের কাছ থেকে পাওয়ার পর তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর দুপুরে তাদের সাবরাং হারিয়াখালী সেনাবাহিনীর ত্রাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে তাদের জন্য নিধারিত অস্থায়ী ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। ##
############
নাফ নদীর মোহনায় ভেসে এল আরও এক রোহিঙ্গার লাশ
জসিম মাহমুদ,টেকনাফ :::
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার সময় রোহিঙ্গা বহনকারী নৌকাডুবির ঘটনায় ভেসে এল আরও এক রোহিঙ্গার লাশ। কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ ঘোলারচর এলাকা থেকে আজ বৃহস্পতিবার এক রোহিঙ্গা পুরুষের লাশ উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। গত রোববার রাতে এই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে।
এই ঘটনায় এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ৩২ জনের মধ্যে ১৬টি শিশু, ১৩ নারী ও ৩ জন পুরুষ রয়েছে।পুলিশ জানায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা থেকে রোববার সন্ধ্যায় নারী, শিশুসহ ৫০ জনের বেশি রোহিঙ্গা ইঞ্জিনচালিত ওই নৌকায় করে টেকনাফে আসছিল। রাত নয়টার দিকে নৌকাটি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের ঘোলারচর এলাকায় নাফ নদী ও সাগরের মোহনায় ঝোড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে ডুবে যায়। তখন অনেকে নিখোঁজ ছিল।
কোস্টগার্ড শাহপরীর দ্বীপ স্টেশন কমান্ডর লেফটেন্যান্ট জাফর ইমাম সজীব বলেন, আজ সকালে সাড়ে আটটার দিকে শাহপরীর দ্বীপ ঘোলারচর এলাকা থেকে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশটি টেকনাফ থানার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন বলেন, লাশটি দাফনের প্রক্রিয়া চলছে।গত ২৯ আগস্ট থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গা বহনকারী ২৫টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৬৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশি। তিনি নৌকার মাঝি ছিলেন। উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে উখিয়া থেকে ২৮ এবং টেকনাফ থেকে ১৩৮ জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৫টি শিশু, ৫২ নারী ও ২৯ জন পুরুষ।
পাঠকের মতামত: