নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার :::
দেশের বৃহত্তম কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুটকি মহালে এখন পুরোদমে শুরু হয়েছে শুটকি উৎপাদনের কাজ। বঙ্গোপসাগর থেকে সংগ্রহ করা ছোট–বড় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ এখানে সূর্যের তাপে শুকানো হচ্ছে। এসব শুটকি উৎপাদনে নিয়োজিত আছেন প্রায় বিশ হাজার শ্রমিক।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মৌসুমে শুধুমাত্র নাজিরারটেক শুটকি মহালে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন বিভিন্ন জাতের শুটকি উৎপাদন করা হয়। যার বাজার মুল্য প্রায় দুইশ কোটি টাকা। উৎপাদিত এসব শুটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করা হচ্ছে।
তবে উদ্বেগের বিষয়, পোকা মাকড় থেকে রক্ষা এবং স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য এসব শুটকিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক। যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু নাজিরারটেক নয়, শীত মৌসুমের শুরু থেকে মহেশখালীর সোনাদীয়া দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়াসহ জেলার উপকুলীয় বিভিন্ন শুটকী মহালে শুটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। সাগরের বেঁড়িবাঁধ এবং বিশেষ উপায়ে তৈরী বাঁশের মাচার উপর পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুটকিতে পরিণত করা হয়।
সোমবার নাজিরারটেক শুটকি মহালে গেলে দেখা যায়, শুটকি শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের কর্মচাঞ্চল্য। যার যার মত সবাই ব্যস্ত। কথাবলারও ফুসরত নেই কারো। সেখানেই একটি আড়তে শুটকি উৎপাদনের কাজ করছিলেন রওশন বেগম (৩১)। রওশন জানান,সেই ভোর থেকে কর্মব্যস্ততা শুরু। সূর্য ডোবা পর্যন্ত এভাবে চলবে।
পাশের আড়তের সুফিয়া বেগম জানান, সারাদিন কাজ শেষে মজুরী পাব ১৮০টাকা। তা দিয়েই চলে সংসার। শুধু রওশন নয়, রওশনের মত প্রায় দশ হাজার নারীসহ প্রায় বিশ হাজার শ্রমিকের আয়–রোজগারের উৎস এই নাজিরারটেক।
নাজিরারটেক শুটকি মহাল মালিক মো. শহিদুল্লাহ জানান, শীত মৌসুম শুরুর আগে থেকে নাজিরারটেক শুটকি মহালেও শুটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। এবছরও রূপচাদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা পোপা, টেকচাদা, হাঙ্গর, ফাইস্যা, নাইল্যামাছসহ ২০–২৫ প্রজাতির শুটকী এ মহালে উৎপাদন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্ষাকাল ছাড়া বছরের নয়মাস এখানে শুটকি উৎপাদন চলে। তবে গত কিছুদিন সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় উৎপাদনে একটু ভাটা পড়েছে। আশা করছি এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে উৎপাদন আবার পুরোদমে শুরু হবে। নাজিরারটেক শুটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি শাহাদাত উল্লাহ জানান, প্রায় একশ একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এ শুটকি মহালে রয়েছে ছোট–বড় অর্ধশতাধিক আড়ত। দেশের সবচেয়ে বড় শুটকি মহাল এই নাজিরারটেক। এখানে ব্যবসায়ীও আছেন প্রায় দুইহাজার। এ মহাল থেকে প্রতিদিন প্রায় দুইশ টন বিভিন্ন জাতের শুটকি উৎপাদন করা হচ্ছে। প্রতি মৌসুমে উৎপাদন হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন শুটকি। যার বাজার মূল্য প্রায় দুইশ কোটি টাকা। এসব শুটকি উৎপাদন কাজে নিয়োজিত আছেন প্রায় বিশ হাজার শ্রমিক।
তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, দেশের বৃহত্তম এ শুটকি মহাল থেকে সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দেওয়া হলেও এখনো নাজিরারটেকে আসার পরিকল্পিত,চলাচলের উপযোগি কোনো রাস্তা নেই। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন এখানে আনতে হয় অতিরিক্ত ভাড়ায়। ফলে একদিকে শুটকির উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে অন্যদিকে শুটকি উৎপাদনেও ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বার বার আশ্বাসের বাণী শুনালেও বাস্তবে কাজ হয়না।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সোনা মিয়া বলেন, শুধু কক্সবাজারের নয়, এখানকার উপযুক্ত (লবনাক্ত) আবহাওয়ার কারণে প্রতিবছর চট্টগ্রাম থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাছ শুকানোর জন্য এই মহালে আনা হয়, এবারও আনা হয়েছে। উৎপাদনও খুব ভাল হচ্ছে। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উৎপাদিত শুটকি সঠিক সময়ে বাইরে পাঠানো সম্ভব না হওয়ায় ভাল দাম পাওয়া যায়নি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস আহমেদ বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষ করে ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুটকি উৎপাদন করা হয়। শুধু কক্সবাজারে নয়, এখানে উৎপাদিত শুটকি ঢাকা,চট্রগ্রাম, রাজশাহী, নাটোরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে মানুষের চাহিদা মেটানো হচ্ছে এবং দেশের মানুষের প্রেটিনের বড় একটি অংশ কক্সবাজারে উৎপাদিত শুটকি থেকে পূরণ হচ্ছে। এমনকি, শুটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহারের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা নিশ্চিত হয়েছি এখানে উৎপাদিত শুটকির স্থায়িত্ব বাড়ানো এবং পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচাতে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। কোনো খাদ্য যদি জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে তা ভাবনার বিষয়। নিরাপদ শুটকি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে আমরা ইতিমধ্যে নাজিরারটেকে ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারীদের নিয়ে বড় একটি সভা করেছি। কয়েকটি এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় সেখানে উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
পাঠকের মতামত: