সরকারি সিলযুক্ত ১৫শ খালি বস্তা ও ২১ বস্তা চাল উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্রগ্রাম :: ‘ডিও’ ব্যবসার আড়ালে সরকারি খাদ্য গুদামের চাল নিয়ে কারসাজি করে আসছে দুই চাল ব্যবসায়ী। খাদ্য বিভাগ ও খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে এই ‘চালবাজি’ চলে আসছে। এমনকি সরকারি খাদ্য গুদামকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগ ছাড়াও সারাদেশের ডিও নিয়ন্ত্রণ করে আসছে এই চক্রটি। এর নেপথ্যে রয়েছে যুবলীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা। তার কব্জায় রয়েছে খাদ্য বিভাগের পরিবহন ও হ্যান্ডলিং ঠিকাদার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কয়েক দফায় অভিযান চালিয়ে সরকারি চাল উদ্ধার করলেও আড়ালে থেকে যায় রাঘর-বোয়ালরা। তাই ঘুণে পোকার মতো খেয়ে ফেলছে সরকারি গুদামের চাল।
গতকাল বুধবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাহাড়তলী বাজারে অভিযান চালিয়ে ফারুক ট্রেডিং এর গুদাম থেকে বিপুল পরিমাণ সরকারি চালের খালি বস্তা ও চাল উদ্ধার করেছে। আগেও ওই দোকান থেকে সরকারি চাল উদ্ধার করা হয়েছিল। জেলও খেটেছিলেন দোকান মালিক।
ডবলমুরিং থানার ওসি (তদন্ত) মো. জহির উদ্দিন বলেন, ‘সরকারি খাদ্য বিভাগের চালের বস্তা পাল্টানোর সময় ফারুক ট্রেডিংয়ের গুদাম থেকে ১৫শ খালি বস্তা এবং ২১ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়।’ এসময় দোকানের কর্মচারী আরাফাত মোস্তফাকে (৩৪) আটক করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সরকারি গুদামের চাল গুদামেই মজুত রাখে ডিও ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে বস্তা পাল্টিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়। করোনাভাইরাস আতঙ্কে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের ২০ জন চাল ব্যবসায়ী এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার থেকে অন্তত ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। বিশেষ করে ডিও ব্যবসায়ীরা রাতারাতি কোটিপতি বনেছেন।
জানা যায়, টিআর, কাবিখা থেকে শুরু করে সরকারি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিও দুই ব্যবসায়ীর হাতের মুঠোয়। জেলা-উপজেলার ডিও ব্যবসায়ীদের আগাম (দাদন) টাকা দেন তারা। ডিও’র সিংহভাগ চাল তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ইতিমধ্যে একাধিক অভিযানে চাল পাচারে অভিযোগে তার নামও ওঠে আসে। সরকারি টিআর, কাবিখাসহ সরকারের বিভিন্ন খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের ডিও নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য গুদাম থেকে চাল উত্তোলন করেনি এসব ব্যবসায়ী। হঠাৎ করে চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠার পর সরকারি গুদাম থেকে ডিও’র বিপরীতে চাল উত্তোলন করে বস্তা পাল্টানোর কারসাজি বেড়ে যায়। বিশেষ করে হালিশহর ও দেওয়ানহাট সিএসডি খাদ্য গুদাম থেকে চাল গ্রহণ বেড়ে যায় ওই ডিও ব্যবসায়ীদের। খাদ্য বিভাগের চট্টগ্রামের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা ও খাদ্য গুদামের ম্যানেজারদের বশে নিয়ে চলে আসছে এই কারসাজি।
২০১৭ সালে হালিশহর সিএসডি গুদাম খোলা বাজারে চাল পাচারকালে বিপুল পরিমাণ চাল জব্দ করেছিল র্যাব। এই ঘটনায় ৭জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। মামলায় খাদ্য বিভাগের দুই কর্মকর্তা, পাহাড়তলী-খাতুনগঞ্জের দুই ব্যবসায়ী ও ট্রাকচালকসহ ৭জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এই মামলার আসামি রয়েছে খাজা ভা-ারের শাহাবুদ্দিনও। অনিয়মের দায়ে সাজা পাওয়া দুই কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম ও আসাদুজ্জামান খাদ্য বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় পদায়ন করা হয়েছে। ফখরুল রয়েছেন বান্দরবানের রুমা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। আর আসাদুজ্জামানকে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা।
সূত্র জানায়, বিশ্বখাদ্য সংস্থা, বিভিন্ন প্রকল্পের অনুকূলে চাপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া জেলা থেকে ভালোমানের চাল সংগ্রহ করেছে খাদ্য বিভাগ। এসব চালের বাজার দর ৪০-৪২ টাকা। ২০-২২ টাকা দরের ডিও নিয়ে উন্নতমানের চাল নিয়ে যায় খাদ্য গুদাম থেকে। খাদ্য বিভাগকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে এসব চাল নিয়ে যায় পাহাড়তলী বাজারের একটি সিন্ডিকেট। দুই ব্যবসায়ী কারসাজি করে বিপুল পরিমাণ চাল গুদাম থেকে খালাস করে। হালিশহর খাদ্যগুদাম ম্যানেজার থোয়াই প্রু মারমার বিরুদ্ধে এই নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সরকারকে। বিপুল পরিমাণ চাল মজুত করে চালের বাজার অস্থির করে তোলার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। উপজেলা থেকে ডিও সংগ্রহ করে হালিশহর ও দেওয়ানহাট খাদ্য গুদাম থেকে চাল সরবরাহ করা হয়। এতে শুধু বরাদ্দের ইনভয়েস আদান-প্রদান করা হয়। চাল যায় গুদামের বদলে খোলা বাজারে। চাক্তাই বা পাহাড়তলী চাল বাজারে। কাগজপত্র ঠিক রেখে চাল পাচার হয় খোলা বাজারে। খাদ্য বিভাগ এবং খাদ্য গুদাম কমকর্তাদের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে পাচার হয়ে আসছিল উন্নতমানের চাল। পরিবহন ঠিকাদারের যোগসাজশে তা করা হচ্ছে। এতে পরিবহন ঠিকাদারও ট্রাক ভাড়া সাশ্রয় হয়। খাদ্য বিভাগ থেকে ভুয়া বিল দেখিয়ে ট্রাক ভাড়ার বিল উত্তোলন করা হয়।
পাঠকের মতামত: