ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের টোকেনে সড়কে ৩ হাজার অবৈধ পিকআপ-ডাম্পার বেপরোয়া

বিশেষ প্রতিবেদক :: কক্সবাজারের আট উপজেলায় মহাসড়ক ও আভ্যান্তরিণ সড়কে স্বস্ব এলাকার ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ ফাড়ির ক্যাশিয়ারের টোকেন নিয়ে প্রায় ৩ হাজার পিকআপ-ডাম্পার চলছে।

এসব গাড়ির ফিটনেস ও বৈধ কাগজপত্র কিছুই নেই। অদক্ষ চালকের গাড়ি চাপায় পিষ্ট হয়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণ। তাদেরকে এ কাজে বাঁধা ও জরিমানা আদায়ের দায়িত্বরত পুলিশ টোকেন বানিজ্য করে প্রতি মাসে আয় করছে কোটি টাকা। এসব ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়ত সংবাদ প্রকাশ হলেও সংশ্্িরষ্ট বিভাগের ঘুম ভাঙ্গেনা। এ অভিযোগ ভুক্তভোগী মহলের।

উল্লেখ্য যে, সামপ্রতিক এক ভয়াবহ দূর্ঘটনায় একই পরিবারের ৫ভাই নিহত হওয়ার পর গ্রেফতারকৃত পিকআপ ড্রাইভারের দেয়া তথ্যে মতে এ ভয়াবহ চিত্রের ঘটনা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।

চকরিয়া-কক্সবাজার মহাসড়কের মালুমঘাটের হাসিনাপাড়া এলাকায সাত ভাই-বোনকে চাপা দেওয়া পিকআপ ভ্যানের রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ ও ট্যাক্স টোকেনের কোনোটিরই মেয়াদ ছিল না। প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে মেয়াদ শেষ হলেও পিকআপটি মহাসড়কে কিভাবে চলাচল করে আসছিল এ প্রশ্ন সকলের। এমন কি ওই পিকআপ ভ্যান যে চালক ছিল তারও কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিলনা। এক কথায় অবৈধ চালক, অবৈধ গাড়ি  ও ছিলনা রোড পারমিট। এরকম হাজারো অবৈধ চালক ও গাড়ি রয়েছে চকরিয়াসহ পুরো কক্সবাজারে।

বিআরটিএ, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্র জানায়, মালুমঘাটের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী পিকআপ ভ্যানটির ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৮ সালের ১২ মে। ট্যাক্স টোকেনেরও মেয়াদ শেষ হয় সাড়ে তিন বছর আগে। আর রুট পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়েছে আড়াই বছর আগে, ২০১৯ সালের ২৮ মে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর ধরে এই পিকআপ ভ্যানটি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হালনাগাদ না করেই রাস্তায় চলাচল করছিল বীরদর্পে। তাদের একমাত্র সম্বল ছিল ৫শত টাকার বিনিময়ে নেয়া একটি ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের কাছ থেকে একটি টোকেন।

শুধু এই পিকআপ নয়, চকরিয়াসহ কক্সবাজার জেলা জুড়ে কাগজপত্র ছাড়া অবৈধভাবে ৩ হাজারের বেশি পিকআপ এবং ডাম্পার প্রকাশ্যে চলাচল করছে। কাঠ, ইট-মাটি পরিবহনসহ অন্যান্য কাজে অবৈধভাবে চলাচলকারি এসব যানবাহনের চালকদের নেই কোন লাইসেন্সও। প্রায় সময় বেপরোয়া গতিতে চলতে দেখা মিলে এসব পরিবহনের।

অভিযোগ রয়েছে, জেলায় তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে চাঁদা দিয়ে বিশেষ টোকেন সংগ্রহ করে এসব অবৈধ পিকআপ-ডাম্পার চলাচল করে। ট্রাফিক পুলিশ, তুলাবাগান ও উখিয়াস্থ শাহপরী হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, চকরিয়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি এবং চকরিয়াস্থ মালুমঘাটা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িকে চাঁদা দিয়ে এসব টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। এক্ষেত্রে জেলায় তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে মাসে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।

ফলে প্রকাশ্যে চলাচলকারি অবৈধ পিকআপ ও ডাম্পারের বিরুদ্ধে কার্যত কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয় না ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ। এসব অবৈধ পিকআপ-ডাম্পারের চাপায় প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

চাঁদা দিয়ে এসব অবৈধ গাড়ি চলাচলের কথা স্বীকার করে চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন মালিক গ্রæপের মহাসচিব মঞ্জুরুল আলম জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চলাচলকারি অনেক গাড়িরই কাগজপত্র ঠিক নেই।
চালকদেরও নেই লাইসেন্স। আইনত এসব যানবাহন রাস্তায় চলাচলের কথা নয়। কিন্তু এরপরও পুলিশকে চাঁদা দিয়ে ঠিকই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। শহর এলাকায় মোটামুটি তদারকি থাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যা কম। কিন্তু জেলার মফস্বল পর্যায়ে এসব নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এতে সেখানে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির দেওয়া তথ্য মতে, কক্সবাজার জেলায় ৩ হাজারের বেশি পিকআপ ও ডাম্পার চলাচল করে আসছে। যেসব যানবাহনের কোন বৈধ কাগজ-পত্র নেই। এমন কি বেশির ভাগ পিকআপ-ডাম্পারের চালক অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং তাদের লাইসেন্সও নেই। মুলত এসব যানবাহন চলে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে। যার প্রথম রুট হিসেবে কক্সবাজার শহর-খুরুশকুল-পিএমখালী এবং রামু। দ্বিতীয়টি লিংকরোড হয়ে টেকনাফ।
তৃতীয়টি রামু হয়ে মহাসড়কের চকরিয়া-পেকুয়া অঞ্চলে।

কক্সবাজার শহর-খুরুশকুল-পিএমখালী এবং রামু চলাচলকারি পিকআপ-ডাম্পার মূলত বেশি ব্যবহার হয় পাহাড়ের কাঠ, মাটি, ইট-বালি পরিবহনে। এ ক্ষেত্রে পিকআপ-ডাম্পার মালিকরা কক্সবাজার ট্রাফিক পুলিশ, তুলাবাগান হাইওয়ে পুলিশের সাথে মাসিক চুক্তি করে থাকে। চুক্তি মতে চাঁদা দিয়ে সংগ্রহ করে বিশেষ টোকেন। সড়কের কোথাও আটকানো হলেই এই বিশেষ টোকেন দেখিয়ে সহজেই চলাচল করে আসছে অবৈধ পিকআপ এবং ডাম্পার সমূহ।

বিশেষ ক্ষেত্রে পাহাড় কাটার মাটি পরিবহনের বনবিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের নামেও চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। লিংকরোড হয়ে টেকনাফ সড়কের চলাচলকারি অবৈধ পিকআপ-ডাম্পারকে একই কায়দায় চাঁদা দিতে হয় ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি তুলাবাগান ও উখিয়াস্থ শাহপরী হাইওয়ে পুলিশকে। রামু হয়ে মহাসড়কের চকরিয়া-পেকুয়ায় চলাচলকারি পিকআপ-ডাম্পার মালিকদের চাঁদা দিতে হয় চকরিয়া সদর ট্রাফিক পুলিশ সহ চকরিয়া হাইওয়ে পুলিশকে।

সংশ্লিষ্ট পিকআপ ও ডাম্পার মালিকদের দাবি, প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করা হয় টোকেন। এ ক্ষেত্রে প্রতি মাসে কমপক্ষে ১ কোটি  টাকা চাঁদা আদায় করে আসছে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান। ফলে অবৈধ পিকআপ-ডাম্পারের বেপরোয়া সড়ক রাজত্ব কোনভাবে শেষ হচ্ছে না। একই সঙ্গে ক্রমাগত বাড়ছে সড়কে প্রাণহানির সংখ্যাও।

গত ৮ ফেব্রæয়ারী ভোরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার মালুমঘাট এলাকায় শ্মশানে বাবার উদ্দ্যেশে পূজা শেষে বাড়ী ফিরতে রাস্তা পার হচ্ছিল ৯ ভাই-বোন। এসময় কক্সবাজারমুখি একটি পিকআপ ভ্যান তাদের ধাক্কা দেয়। এ ঘটনায় ৫ ভাই নিহত এবং ৩ জন আহত হন। এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে দুই ভাই-বোন। এদের মধ্যে রক্তিম সুশীল নামের একজনের অবস্থা আশংকাজনক।

এ ঘটনায় মঙ্গলবার (৮ ফেব্রæয়ারী) রাতেই নিহতদের ভাই পল্লব সুশীল বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় অজ্ঞাতনামা চালককে আসামি করে মামলা করেন।

এ ঘটনার পর অবৈধ পিকআপটি জব্দ করা সম্ভব হলেও চালক পালিয়ে গিয়েছিল। গাড়ীটির বৈধ কোন কাগজপত্র না থাকায় ঘটনার চারদিন পরও চালক ও মালিককে পুলিশসহ আইন-শৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদেও পক্ষে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যদিও শুক্রবার মধ্যরাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় আত্মগোপন অবস্থায় ঘাতক গাড়ীটির চালককে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় র‌্যাব। রোববার তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।

চাঁদার বিনিময়ে মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল ও লাইসেন্স বিহীন চালকদের গাড়ী চালানোর সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক শাফায়েত হোসেন।

শাফায়েত হোসেন বলেন, মহাসড়কে চলাচলকারি যানবাহনগুলো হাইওয়ে পুলিশ নিয়মিত তদারকি করে থাকে। যেসব যানবাহন ও চালকদের বিরুদ্ধে বৈধ কোন কাগজপত্র পাওয়া যায় না তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনে নিয়মিত মামলা রজ্জু করা হচ্ছে।

তবে চাঁদার বিনিময়ে বৈধ কাগজপত্র-লাইসেন্স বিহীন কোন গাড়ী ও চালককে চলাচলের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি।
একই ধরণের মন্তব্য করেছেন রামু তুলাতলী ক্রসিং হাইওয়ে থানার ওসিও।

পাঠকের মতামত: