ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

জাতীয় নির্বাচনের ‘ধারণা’ পেলো বিএনপি, অচিরেই মূল্যায়ন

সালমান তারেক শাকিল, বাংলা ট্রিবিউন:
সদ্য সমাপ্ত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় ‘রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী’ হয়েছে বিএনপি, এমনটি মনে করছেন দলটির নেতারা। তারা বলছেন— খুলনা সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রার্থী পরাজিত হলেও ‘রাজনৈতিকভাবে’ বিজয়ী হয়েছেন তারা। এক্ষেত্রে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সরকার কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে চায়, সে বিষয়টিও ওঠে এসেছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হেরে যাওয়া, নির্বাচন কমিশনে একাধিকবার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থানসহ খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হবে। এ উদ্দেশ্যে অচিরেই বিএনপির স্থায়ী কমিটিসহ সিনিয়র নেতারা বৈঠকে বসবেন।

মঙ্গলবার (১৫ মে) অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে পরাজিত করেন। এই পরাজয়ের পর বিএনপির তরফে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের অযোগ্যতা, ব্যর্থতা ও পুলিশি হামলার কারণে কেসিসি নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মীরা দাঁড়াতে পারেননি। সাধারণ ভোটাররাও ভোট দিতে পারেননি। এ কমিশন পুরোপুরি অযোগ্য, তাই ইসির পুনর্গঠন করতে হবে।’

কেসিসি’র নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকৌশল সম্পর্কে বুধবার (১৬ মে) বিএনপির কেন্দ্রীয় ও খুলনার সিনিয়র একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তারা বলছেন, খুলনায় দলের প্রার্থী হারলেও রাজনৈতিকভাবে বিএনপি লাভবান হয়েছে। নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য ত্রুটি-বিচ্যুতি, সমস্যা নিরূপণ করতে একাধিকবার বিএনপির প্রতিনিধি দল আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছে। এসব অভিযোগ অনেকটাই আমলে নেয়নি ইসি। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়ে অভিযোগ দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করে ইসি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার অভিযোগ করেছেন, তিনি নিজেও বিভিন্ন বিষয়ে সিইসিকে ফোন করে জানিয়েছেন। এরপরও সিইসি কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।

বিএনপি নেতারা মনে করেন, খুলনা নির্বাচনে পুলিশের সামনেই জালভোট প্রদান, মানুষের অংশগ্রহণ না থাকার কারণে রাজনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান ইসির অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার শঙ্কা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘আসলে খুলনায় বিএনপি পরাজিত হয়নি। পরাজিত হয়েছে স্বাধীনতার, ভোটাধিকারের, নৈতিকতার, শিষ্টাচারের। বিএনপি আপ্রাণ চেষ্টা করেছে নৈতিকতা ধরে রাখার। কিন্তু কোনোভাবেই স্বৈরতন্ত্রের কাছে রাখা সম্ভব হয়নি।’

শামসুজ্জামান দুদু অভিযোগ করেন, ‘দেশে স্বৈরতন্ত্র চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। নগ্নভাবে নির্বাচনটাকে ব্যবহার করবে, তা বুঝতে পারি নাই। একাত্তরের যুদ্ধটাকে কী মর্মান্তিকভাবে লজ্জায় ফেলে দিলাম। যে অধিকার পেয়েছিলাম, তা আওয়ামী লীগ নষ্ট করে দিলো।’

তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচন থেকে মেসেজ হচ্ছে— সরকার ক্রমান্বয়ে সমর্থন হারাচ্ছে। এরপরও তারা গায়ের জোর ব্যবহার করছে। গুণ্ডামিতন্ত্রের বহির্প্রকাশ করছে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের সঙ্গে তামাশা করছে। বিএনপি নির্বাচনে না গেলে, এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যেত না, সরকার ভোটে কত লুটপাট করে। অংশগ্রহণ করেছি বলেই সারাবিশ্বও বুঝতে পেরেছে, মূলত আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে।’

বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তার ভাষ্য— ‘সবার কাছে প্রমাণিত হয়েছে, সরকার কীভাবে নির্বাচনে দখলপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। সামনের নির্বাচনেও দখলপ্রক্রিয়া কীভাবে করবে, এটা তার আগামবার্তা। এই বার্তা দেশের সব রাজনৈতিক পক্ষরাও পেয়েছে। সরকার খুব ঠাণ্ডা মাথায় খুলনায় ভোট কারচুপি করেছে।’ প্রভাবশালী একটি সূত্রের দাবি, বিএনপি এখনই পুরোপুরি ইসির ওপর অনাস্থা পোষণ করবে না। পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিলেও ধীরে-ধীরে কমিশন থেকে সরে আসবে। বিশেষ করে খুব জরুরি না হলে ইসি’র মুখোমুখি হবে না বিএনপি। মানসিকভাবে দূরাবস্থান বজায় রাখা হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুর নির্বাচনের পরিবেশ ও আয়োজন দেখে অবস্থান চূড়ান্ত করবে দলটি।

খুলনা নির্বাচনের পর স্থানীয়ভাবেও বিএনপির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে— নির্বাচনের আগে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, নগরীর নদীর ওপার থেকে বহিরাগত, ছাত্রলীগ-যুবলীগের যৌথ উদ্যোগে ভোট কারচুপি হয়েছে। এর জন্য পুলিশ ও ইসিকে দায়ী করছেন তারা।

খুলনা সিটি করপোরেশনের বিদায়ী মেয়র মনিরুজ্জামান মনি বলেন, ‘ভোট কাটার মহোৎসব হয়েছে। এই ভোটের কোনও ইতিবাচক প্রভাব নেই। নেতিবাচক প্রভাব আছে। মানুষ হতাশ। পুলিশের সহযোগিতায়, ইসির সহযোগিতায় ভোট কেটে নিয়ে গেলো।’
মনিরুজ্জামান মনি মনে করেন, ‘খুলনার সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন দেশের গণতন্ত্রের জন্য বাজে সংবাদ। আমরা সব মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা হলো না। সরকার বাছাই করে খুলনায় পুলিশ এনেছে, জাল ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। আগের রাত পর্যন্ত বিরোধী দলের কর্মী ও পোলিং এজেন্ট— সবাইকে গ্রেফতার করেছে। বাড়ি বাড়ি হানা দিয়েছে। যাতে করে মাঠে কাউকে পাওয়া যায়নি। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড যেন না পায়। শুধুমাত্র কাউকে বসাতে হবে, এই জন্যই নির্বাচন।’ বিদায়ী মেয়র আরও দাবি করেন, ‘নির্বাচনে থার্টি পার্সেন্ট ভোট কাটা হয়েছে। নদীর ওপারের লোক, মহানগরীতে বসবাসকারী ছাত্রলীগ, যুবলীগ হল্লা করে ভোট-বইয়ে সিল দিয়েছে।’
মনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ‘আমরা আসলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। এই সরকার গাজীপুর নির্বাচনেও তাই করবে, একতরফা নিয়ে যাবে।’

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, খুলনা নির্বাচনের সব খুঁটিনাটি নিয়ে মূল্যায়ন করবে বিএনপি। অচিরেই এই মূল্যায়নের জন্য বৈঠকে বসবেন স্থায়ী কমিটিসহ সিনিয়র নেতারা।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে মূল্যায়ন করবো। আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হচ্ছে— সরকারের প্রশাসন, সরকার দলীয়রা এক হয়ে গায়ের জোরে ভোট জিতে নিয়েছে। এটা তাদের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। অবশ্যই আগামী নির্বাচন কেমন হবে, এর একটা বার্তা আমরা পেলাম।’

বিএনপির অন্যতম এই নীতিনির্ধারক বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে। কিন্তু তারা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেবো।’

পাঠকের মতামত: