ডাক পড়েছে জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে
নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদবিরোধী প্রবন্ধ লিখে দেশসেরার খ্যাতি অর্জন করেছেন কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার অজপাড়ার তনিমা আফরোজ। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এনজিও সংস্থা গ্লোবাল কমিউনিটি এনগেজমেন্ট অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স ফান্ড (জিসিইআরএফ) এর তত্ত্বাবধানে এবং অর্থায়নে দেশীয় কয়েকটি এনজিও সংস্থা দায়িত্ব পান উগ্রবাদ বিষয়ে বাংলাদেশের তিন জেলার ১০ কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে রচনা প্রতিযোগিতা কর্মসূচির। সেই কর্মসূচির আলোকে রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন পেকুয়ার শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজের একাদশ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তনিমা আফরোজ। প্রতিযোগিতায় ১০ কলেজের বাছাইকৃত শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে দেশসেরা নির্বাচিত হন তনিমা। এর মধ্য দিয়ে কপাল খুলে গেছে দরিদ্র পরিবারের সন্তান মেধাবী তনিমার। ইতোমধ্যে তনিমার জন্য ডাক আসে জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে উপস্থিত হতে। জাতিসংঘের এই অধিবেশনে মূলত তনিমা আফরোজ যোগ দেবেন সুইজারল্যান্ডের হয়ে। যা শুধু পেকুয়া বা কক্সবাজার জেলা নয়, পুরো বাংলাদেশের গর্বের বিষয়।
তনিমার এই অর্জনে গর্বিত অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেছেন, এই তনিমা এখন আর সেই তনিমা নয়। সে আমাদের জন্য বিশাল এক সম্মান নিয়ে এসেছে। যা পুরো বাংলাদেশকেই আলোকিত করেছে। একই বিষয়ের ওপর আর্টিক্যাল লিখে যেভাবে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই। হয়তো মালালার মতোই বাংলাদেশের তনিমাও পুরো বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেওয়ার অন্তিম সময়ের প্রহর গুনছি আমরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী অক্টোবর মাসে শুরু হতে যাচ্ছে জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশন। সেই অধিবেশনে উপস্থিত থাকবেন তনিমা আফরোজ। সেখানে বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতে তনিমা তুলে ধরবেন বাংলাদেশের জন্য ক্যান্সারের মতো হয়ে ওঠা উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে জানবেন বাংলাদেশের এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়। তনিমা আফরোজের নিকটাত্মীয়রা জানান, ছোটকাল থেকেই বাবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে পড়ালেখার খরচ বহন তো দূরের কথা, প্রতিদিন দুই বেলা খাবারও ঠিকমতো জোটতো না তনিমাদের। এই অবস্থায় সংসারের হাল ধরতে গার্মেন্টস শ্রমিকের কাজ নেন তনিমার মা সাবিনা আফরোজ। এ কারণে মায়ের আদর-ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত হতে হয় তনিমাকে। তখন ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে নানা (মায়ের বাবা) তনিমাকে নিয়ে যান মামার বাড়িতে। সেখানে চলে পড়ালেখার পাঠ। সেইসঙ্গে মামার বাড়ির লোকজন তনিমাকে বোঝতেই দেননি অভাব কী। তনিমাও নানা-মামাদের যত্ন-আত্তিতে বড় হচ্ছিল, সেইসাথে পড়ালেখায় বেশ মনোনিবেশ ঘটে তনিমার।
শুধু তাই নয়, তনিমা যে দিন দিন নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন তাতে বেশ মুগ্ধ মামার বাড়ির সদস্যরা। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় (জেএসসি) গোল্ডেন এ প্লাস এবং পরবর্তীতে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় (এসএসসি) এ গ্রেড নিয়ে কৃতিত্ব দেখান তনিমা আফরোজ। বর্তমানে পেকুয়া জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজে তনিমা অধ্যয়ন করছেন একাদশ দ্বিতীয় বর্ষে। তনিমাদের বাড়ি পেকুয়া সদর ইউনিয়নের আনর আলী মাতবরপাড়ায়। তিনি ওই পাড়ার মিজান উদ্দিন ও সাবিনা আফরোজ দম্পতির কন্যা। এই দম্পতির সংসারে রয়েছে আরেক পুত্র সন্তান। সে চট্টগ্রাম শহরের একটি প্রাইভেট স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে এবং থাকছে মায়ের সঙ্গে।
পেকুয়ার সংবাদকর্মী ইমরান হোসাইন জানান, মিজান উদ্দিন ও সাবিনা আফরোজ দম্পতির সন্তান তনিমা আফরোজ অন্য শিশু-কিশোরের মতোই বিলাসী জীবন পাননি। বাবা মিজান উদ্দিনের শারীরিক অসুস্থতার কারণে পরিবারে দেখা দেয় আর্থিক দুরবস্থা। এই পরিস্থিতিতে স্বামীর পরিবর্তে সংসারের হাল ধরতে চট্টগ্রামের একটি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে (গার্মেন্টস) চাকরি নেন সাবিনা আফরোজ। তাই কোলের সন্তান তনিমার ঠাঁই হয় নানার বাড়িতে। সেই তিন মাস বয়স থেকে অদ্যাবধি নানার বাড়িতেই থেকে বড় হয়েছেন তনিমা। এ কারণে বাবা-মায়ের আদর-ভালোবাসা বঞ্চিত হলেও তনিমাকে সেই অভাব বোঝতেই দেননি নানা শামশুল আলম চৌধুরী।
ইমরান বলেন, ‘তনিমা যখন বড় হচ্ছিল আর সবকিছুই বোঝতে শিখছিল তখন থেকেই দারিদ্র্য কি জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। এই দারিদ্রই যে তনিমাকে মা-বাবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে তাও ভালোভাবে রপ্ত হয় তাঁর। তাই নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেন তনিমা। এতে সফলতাও হাতছানি দেয়। একে একে তিনটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন তনিমা।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেকুয়া প্রি-ক্যাডেট স্কুল থেকে পিইসি ও পেকুয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরীক্ষায় তনিমা রাখেন মেধার স্বাক্ষর। দুই পরীক্ষায় পায় গোল্ডেন এ প্লাস। একই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় পান এ গ্রেড। পরে উচ্চ মাধ্যমিকে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন পেকুয়া শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজে। বর্তমানে এই কলেজের ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত তনিমা। তাঁরই নানা শামসুল আলম চৌধুরীর একান্ত সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা জয় করে পড়ালেখায় মেধার স্বাক্ষর রাখেন তনিমা আফরোজ। সমপ্রতি এনজিও সংস্থা কোডেক-তরুণ আলো প্রকল্প আয়োজিত উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় দেশসেরা হন তনিমা। এই এনজিও সংস্থা ১০০০ শব্দের মধ্যে তনিমার লেখা এই প্রবন্ধ পৌঁছে দেন জাতিসংঘের সদর দপ্তরে। সেখানে বিচার বিশ্লেষণ শেষে তাঁর ডাক পড়েছে জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে।
এনজিও ইলমা-তরুণ আলো প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনার সমাজে যদি উগ্রবাদ ও সহিংসতা ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রে একজন তরুণ হিসেবে আপনার কি ভূমিকা বা আপনি কি করতে পারেন।’ এরই আলোকে ১০০০ শব্দের মধ্যে এই প্রবন্ধ লেখার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। পাশাপাশি এই বিষয়ে ৬০ সেকেণ্ডের সাক্ষাৎকারমূলক একটি প্রামাণ্যচিত্রও ধারণ করা হয়। যাতে জাতিসংঘের অধিবেশনে বিষয়টি ইংরেজিতেও ভালোভাবে তুলে ধরা যায়। সবকিছু বিবেচনায় দেশসেরা নির্বাচিত করা হয় তনিমাকে। এর মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেবেন তনিমা।’
এদিকে তনিমা আফরোজ জীবনের শ্রেষ্ঠ এই অর্জন নিয়ে কথা বলেন সাংবাদিকদের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমার ক্ষুদ্র জীবনে এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য। মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীর আলোয় আসার পর থেকে অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে আমাকে। তবে সেই আক্ষেপ আর মনে ধরছেনা, যখন ডাক পেলাম আমার মতো নগণ্য একজনকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে উপস্থিত হওয়ার।’ তনিমা বলেন, ‘এজন্য আমি মহান সৃষ্টিকর্তা, আমার প্রাণপ্রিয় নানা ও শিক্ষকসহ তরুণ আলো প্রকল্পের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। এখন থেকেই সকলের ভালোবাসায় আমি মানব জাতির কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই। সেইসঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সারাজীবন মা-বাবার পাশে থেকে তাঁদের সেবা করে যেতে চাই।’
এ ব্যাপারে কোডেক-তরুণ আলো প্রকল্পের পেকুয়া শাখার মাঠ কর্মকর্তা মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় জুলাই মাসের ৮ তারিখ একযোগে খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১০টি কলেজের বাছাইকৃত শতাধিক শিক্ষার্থী জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ বিষয়ে প্রবন্ধ লেখা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।’
কোডেক-তরুণ আলো প্রকল্পের কক্সবাজার জেলা শাখার ম্যানেজার কামরুল ইসলাম বলেন, ‘সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এনজিও সংস্থা জিসিইআরএফ উপর্যুক্ত বিষয়ের প্রতিযোগিতায় দেশসেরা হওয়া তনিমা আফরোজকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সুইজারল্যান্ড দূতাবাস এ ব্যাপারে তনিমা আফরোজকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি এবং সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্নের কাজ চলমান রয়েছে।’
পাঠকের মতামত: