কক্সবাজার প্রতিনিধি ::
পর্যটননগরী কক্সবাজার শহরের কলাতলীর আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ, এপার্টম্যান্টে মূসক ফাঁকির মহোৎসব চলছে। গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করলেও সরকারি কোষাগারে জমা করছে না মালিকেরা। এতে প্রতি বছর আবাসিক হোটেল গুলো থেকে শত কোটি ভ্যাট হারাচ্ছে সরকার।
জানা গেছে, পর্যটন এলাকার আবাসিক হোটেলগুলো সঠিকভাবে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) পরিশোধ করছে না। ভরা মৌসুমে হোটেলগুলো রমরমা ব্যবসা করে। পর্যটকদের কাছ থেকে আদায় করা হয় বিপুল পরিমাণ মূসক। এগুলো সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে নানা কৌশলে ফাঁকি দেয় তারা। কখনো পর্যটকের সংখ্যা কম দেখিয়ে, কখনো ভ্যাটের নিবন্ধন না নিয়ে, আবার কখনো হোটেল ভাড়া কম দেখিয়ে ফাঁকি দিচ্ছে বিপুল ভ্যাট।
প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, প্রতিবছর অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পর্যটন মৌসুম। এ সময় দেশি-বিদেশি পর্যটকরা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণে আসেন। বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্ট, ফ্ল্যাট, কটেজসহ আবাসিক স্থাপনা গুলোতে পর্যটক সমাগম বৃদ্ধির পাশাপাশি সেবার পরিধিও বাড়ে। অথচ পর্যটনের বিশাল একটি খাত ‘আবাসিক’ থেকে রাজস্ব আয় মোটেও সন্তোষজনক নয়। হোটেল কর্তৃপক্ষের ভ্যাট ফাঁকির কারসাজির সাথে জড়িত আছে একটি অসাধু চক্র।
কলাতলীর হোটেল সী প্যালেসের বিপরীত পাশে অবস্থিত ‘হোটেল সী ব্রীজ’। সী ব্রীজ হোটেলটি বর্তমানে ভাড়ায় পরিচালনা করেন রহমত উল্লাহ নামে এক ব্যক্তি। এই হোটেলে কক্ষ আছে ৫০টি। গেল ডিসেম্বর মাসে এই হোটেলে কক্ষ ভাড়া হয়েছে নূন্যতম ১২ লাখ টাকার। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ ডিসেম্বর মাসে রুম বিক্রি দেখিয়েছে মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বিপরীতে নামমাত্র ভ্যাট পরিশোধ করেছে। আরও প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে হোটেলটি।
হোটেল সী ব্রিজের ম্যানেজার মো. ফারুক হোসেনের কাছে মূসক ফাঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
পাশ্ববর্তী হোটেল বীচ হলিডে কক্ষ আছে ৫০ টি। গেল ডিসেম্বর মাসে এই হোটেল কর্তৃপক্ষ রুম বিক্রি দেখিয়েছে মাত্র ৬৪ হাজার ৫০০ টাকা। এই টাকার বিপরীতে ডিসেম্বর মাসে ভ্যাট দিয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৬৭৫ টাকা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ডিসেম্বর মাসে নূন্যতম রুম বিক্রি হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকার। আরও প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে হোটেলটি।
বীচ হলিডে হোটেলের ম্যানেজার স্বপন দে বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। এসব বিষয় আমার জানা নেই।’
হোটেল সী আলিফে কক্ষ আছে ৮৫টি। ডিসেম্বর মাসে এই হোটেল কর্তৃপক্ষ রুম ভাড়া দেখিয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। বিপরীতে ভ্যাট দিয়েছেন ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু দৈনিক রুম ভাড়া হিসেবে এই হোটেলের মাসিক রুম বিক্রি প্রায় ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিমাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মূল্য সংযোজন কর ফাঁকি দিচ্ছে।
হোটেল সী আলিফের ম্যানেজার জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বেশিরভাগ রুম বিক্রির ৫০ শতাংশ দালালদের কমিশন দিতে হয়। তাই কাগজে-কলমে যত টাকার রুম বিক্রি হয় বাস্তবে তত টাকা হোটেল কর্তৃপক্ষ পায় না। তাই ভ্যাটে গরমিল হয়।’ কিন্তু দালালদের কমিশন বাদ দিয়ে হিসাব করলেও বিপুল পরিমাণ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দেয় হোটেলটি। এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
কলাতলীর প্রায় ১২ টি হোটেলের মূসক চালান পর্যালোচনা করে ভ্যাট ফাঁকির ভয়াবহ এ তথ্য পাওয়া গেছে। একইভাবে কলাতলীর প্রায় ৪ শতাধিক আবাসিক হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজ, কটেজে ভ্যাট ফাঁকির মহোৎসব চলছে।
বুধবার (১৬ জানুয়ারী) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হোটেল মোটেল জোনে পর্যটক হয়রানি রোধে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসনের তিনটি মোবাইল কোর্ট টীম। অভিযানে ভ্যাট ফাঁকির এসব তথ্য প্রমাণ উঠে আসে। কিন্তু ভ্যাট ফাঁকির জন্য প্রথমদিন কোন ব্যবস্থা নেয়নি মোবাইল কোর্টের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ।
জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্টের একটি টীমের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম জয় বলেন, ‘পর্যটক হয়রানি ঠেকাতে আমাদের তিনটি টীম কলাতলীর ১২ টি হোটেলে অভিযান চালিয়েছে। অভিযানে প্রতিটি হোটেলে ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি ধরা পড়ে। প্রত্যেক হোটেল কর্তৃপক্ষ ভয়াবহ জালিয়াতির মাধ্যমে মোটা অংকের ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। বিষয়টি আমরা নোট করে নিয়েছি। এবিষয়ে ডিসি স্যারকে অবহিত করা হবে। ডিসি স্যারের নিদের্শনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কক্সবাজার ট্যুরিজম সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, ‘হোটেল ব্যবসায়ীদের অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। সব সময় একই রকম রুম ভাড়া হয় তা কিন্তু নয়। কিন্তু খরচ সারা বছর একই। আমাদের সংগঠন থেকে সবাইকে বলে দেওয়া আছে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে ভ্যাট পরিশোধ করে দেশের উন্নয়নে শামিল হওয়ার জন্য। তারপরও কিছু এদিক ওদিক থাকতে পারে।’
ব্যবসায়ীদের একটি সূত্র বলছে, মূসক আইন অনুযায়ী আবাসিক হোটেল ভাড়ার ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু হোটেল মালিকেরা প্রকৃত বিক্রির তথ্য গোপন করে ভূয়া একটি তালিকা তৈরী করে ন্যূনতম বিক্রি দেখিয়ে সামান্য মূসক পরিশোধ করে। বিপরীতে মোটা অংকের ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। এতে করে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
শহরের কলাতলীতে প্রায় ৮০টি এপার্টমেন্ট বিল্ডিং রয়েছে। এসব বিল্ডিংয়ে প্রায় সাড়ে ৩৫ হাজার ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ফ্ল্যাট গুলো পর্যটকদের ভাড়া দিয়ে রমরমা ব্যবসা করছে কতিপয় ব্যবসায়ীরা। যেগুলো এক টাকাও ভ্যাট দেয় না সরকারকে। অথচ শুধুমাত্র একটি ফ্ল্যাটে মাসিক ভাড়া হয় ন্যূনতম ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। ফ্ল্যাট গুলো ভ্যাট ফাঁকির কারখানা হয়ে উঠেছে।
পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিপুল পরিমাণ ফ্ল্যাট থেকে ভ্যাট আদায়ের জন্য সরকারের কোন বালাই নেই। কিন্তু এটি ভ্যাট আদায়ের অন্যতম একটি খাত। সরকারকে ফ্ল্যাট ব্যবসা থেকে ভ্যাট আদায়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
এনবিআরের একটি সূত্র বলছে, কক্সবাজারের পর্যটনের অংশ হিসেবে আবাসিক হোটেল গুলো রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনাময় খাত হলেও করযোগ্য অনেক প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট জালের বাইরে আছে। এ খাত থেকে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়।
এনবিআরের নির্দেশনায় বলা আছে, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের অধিক্ষেত্রভুক্ত এলাকার হোটেল-রিসোর্টে সরেজমিন পরিদর্শন করতে হবে। এ সময় তারা হোটেলে রেজিস্ট্রার পরীক্ষা করে দেখবেন। মদ জাতীয় পানীয় সরবরাহ বা ফ্লোর শোর আয়োজন করা হলে তার আলাদা হিসেবে নিতে হবে। পাশাপাশি হোটেলগুলোয় অবস্থানকারী পর্যটক সংখ্যার সঙ্গে ঘোষিত সংখ্যা যাচাই করতে হবে। কিন্তু কক্সবাজারে এনবিআরের নিদের্শনা সঠিকভাবে পালন হয় না বলে অভিযোগ আছে।
কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কক্সবাজার সার্কেলের রাজস্ব কর্মকর্তা আবছার উদ্দিন বলেন, ‘হোটেল মালিকেরা যে রেইট তালিকা দেয় সে অনুযায়ী ১৫ শতাংশ ভ্যাট আমরা আদায় করি। মৌসুম ভিত্তিক বিবেচনা করেও ভ্যাট আদায় করা হয়। যদি হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে দেখানো তালিকার চেয়ে বেশি টাকা আদায় করে থাকে সেটি বন্ধে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।’
উল্লেখ্য, ভ্যাটের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী হোটেলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া হোটেল ও রেস্তোরাঁয় মদ জাতীয় পানীয় সরবরাহ করা হলে এবং বিদেশি শিল্পী নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে আরও অতিরিক্ত ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করার নিয়ম আছে।
পাঠকের মতামত: