ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় সরকারি টাকায় মাতামুহুরী নদীতে বাঁধ দিয়ে জাফরের মৎস্য ঘের

Mizbah-News-Pic-2-313x540-313x540কক্সবাজার প্রতিনিধি :::
চকরিয়ার মাতামুহুরী নদীর উপর অবৈধভাবে বাঁধ তৈরি করে চিংড়ী ঘের তৈরি করেছেন চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ সভাপতি জাফর আলম। সরকারী কোটি টাকায় চিরিঙ্গা ইউপির সওদাগরঘোনা (পালাকাটা) অংশে বাঁধ দিয়ে ওই মৎস্যঘের তৈরী করা হয়। আর এই অবৈধভাবে নদী দখলের কারনেই গত দুইদিনের ভারি বর্ষণে নদী দিয়ে উজানের পানি নামতে না পেরে চকরিয়া উপজেলার দু’কুল উপচে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়েছেন। এতে চকরিয়া-পেকুয়ার দুই লাখ মানুষ গত দুদিন ধরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এমনটাই অভিযোগ করেছেন খোদ সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ সহ সওদাগর ঘোনার অনেকেই।
তবে অভিযুক্ত জাফর আলম বলেন, এই চিংড়ী ঘেরের কারনেই প্লাবন ও কাদা থেকে রক্ষা পায় সওদাগর ঘোনার লোকজন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বছর খানেক আগে কোন প্রকার অনুমতি ব্যতিত ঘেরটি গড়ে তোলেন উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম। স্থানীয়ভাবে প্রশাসনকে না জানিয়ে বাধটি তৈরি হওয়ার পর এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা কথা আলোচিত হচ্ছে।
সরকারি দলের নাম ভাঙ্গিয়ে মাতামুহুরী নদীর মূল অংশে ‘কাজের বিনিময়ে টাকা’ কর্মসূচির আওতায় প্রায় এককোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে দুটি বাঁধ নির্মাণ ও নদীর একটি অংশে লোপকাটিং করা হয়েছে। ওই বাঁধ দুটি নির্মাণের কারণে এ নদীর আবহমান কাল থেকে প্রবাহিত পানির মূল ¯্রােতধারা বন্ধ হয়ে গেছে। ওই বাঁধের একটি অংশে লোপকাটিং করে (খাল কেটে নদীর গতিপথ পরিবর্তন) নদীটির দিকও পরিবর্তন করে দেয়া হয়। সেখানে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ৫৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। ওই বরাদ্দের টাকা দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রায় তিন’শ একরের মৎস্যঘেরটি তৈরী করেন। সেখানে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড পালাকাটা রাবার ড্যাম মেরামতের নামে দুইকোটি টাকা দিয়েছে। ওই বরাদ্দের টাকা দিয়ে জাফর আলম নিজের মৎস্যঘেরটি তৈরী করেছেন।
এবিষয়ে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, জাফর আলম একদিকে উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি প্রভাব খাটিয়ে সরকারি অর্থ দিয়ে চলমান নদীতে বাধ দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত মৎস্যঘের তৈরি করেছেন।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, সরকারি টাকা ব্যয়ে ব্যক্তিগত মৎস্যঘের বানাতে গিয়ে মাতামুহুরী নদীর ওই বাঁধ দুইটি এখন চকরিয়া-পেকুয়া মানুষের গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের লাভের জন্য সরকারি টাকা ব্যয়ে এ বাঁধ দুটি নির্মাণ করেছেন। এতে সরকারি টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রকল্পটি কাজের বিনিময়ে টাকা হলেও এখানে মাটি কাটা হয়েছে মেশিন দিয়ে। অভিযোগ উঠেছে; এ প্রকল্পের বেশিরভাগ টাকা সংশ্লিষ্টরা ভাগাভাগি করে আত্মসাত করেছেন। ওই বাঁধের কারণে মাতামুহুরী নদীর প্রায় তিনশ একরের জমি বের করে নিয়ে ওই জমিগুলো সংশ্লিষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম জবর দখল করে সেখানে বিশাল চিংড়ি ঘের তৈরি করেছেন।
নদীটির গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়ায় সওদাগর ঘোনার ব্যাপক এলাকার ফসলি জমি ও বসতি নদী ভাঙনের কবলে পড়ছে। উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম মাতামুহুরী নদীকে গ্রাস করে তৈরী করেছেন মৎস্য ঘের। জমিতে জলাবদ্ধতা ও কৃষকদের চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে জমিতে বীজতলা করার আর উপায় নেই। সামান্য বর্ষাতেই ডুবে যায় ভূমিহীন কৃষকদের বাড়ির আঙিনা। অনেক ভূমিহীনের বসতভিটা জলমগ্ন হয়ে পড়বে।
অপরদিকে এলাকার চিংড়ি চাষিরা জানায়, কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি মাতামুহুরী নদীর চিংড়ি জোনের রামপুর ও চরনদ্বীপ এলাকার টাক্কার ফাঁড়ি খাল, চারালিয়া খাল, বুড়ি পুকুরের বাটামনি খাল, মাছ কাটা খাল, ধুইজ্যার খাল ও ইছার ফাঁড়ি খালে বাঁধ দিয়ে অবৈধভাবে চিংড়ি চাষ করছে। খালগুলোতে অবৈধভাবে বাঁধ দেয়ায় খাল দিয়ে পানি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বাঁধের কারণে স্বাভাবিকভাবে বৈধ চিংড়ি ঘের মালিকরা তাদের ঘেরে পানি ঢুকাতে পারছেন না।
এদিকে গত দুদিনের টানা বর্ষণে চকরিয়া উপজেলার বমুবিলছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বিএমচর, সাহারবিল, কোনাখালী, চকরিয়া পৌরসভার একাংশ, চিরিঙ্গার একাংশের ব্যাপক এলাকা বন্যা কবলিত হয়। পেকুয়ার শীলখালী, বাঘগুজারাও বন্যার পানি উঠে। এসব এলাকায় প্রায় দু’লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি রয়েছে।
সুরাজপুর-মানিকপুরের চেয়ারম্যান আজিমুল হক জানান, তার ইউনিয়নে দক্ষিণ সুরাজপুর ও উত্তর মানিকপুরের ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
বরইতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার জানান, বরইতলীর মুন্সিঘোনা, বিবিরখিল, পশ্চিম গোবিন্দপুর ও বেড়িবাঁধের চারটি অংশে ভেঙ্গে গেছে।
বানিয়াছড়া মগনামা সড়ক পানিতে ডুবে গেছে। ঐ ইউনিয়নে প্রায় দুই হাজার বাড়ি ঘরে পানি উঠে।
সাহারবিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহসিন বাবুল জানান, জলস্যা সড়কটি পানির তোড়ে ভেঙ্গে চার শতাধিক বাড়ি-ঘরে পানি উঠেছে।
চিরিঙ্গার ইউপি চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বলেন, মাতামুহিুরী নদীর উপরেই চিংডিঘেরটি তৈরি হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম বলেন, বাঁধ কিংবা ঘেরের কারণে এলাকাবাসী লাভবান হয়েছে। এই বাঁধের কারনে তাকে পুরষ্কার দেওয়া উচিৎ।
আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাহেদুল ইসলাম বলেন, ওই চিংড়ী ঘের নিয়ে অনেক ধরনের কথা রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে তিনি মন্তব্য করতে নারাজ জানিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলতে বলেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, গত কয়েক মাস যাবৎ ঘেরটি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক আলোচনা হয়েছে। এজন্য একটি কমিটি করা হয়। কমিটি প্রতিবেদনও দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, প্রজেক্টের কারনে যদি রাষ্ট্র কিংবা লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে অবৈধভাবে দখল হওয়া ঘেরটি উচ্ছেদ করা হবে। আর যদি রাষ্ট্র লাভবান হয় তবে আগামী বছর সেটিকে জলমহল ঘোষনা করে ওপেন ট্রেন্ডারের ব্যবস্থা করা হবে। দৈনিক কক্সবাজার

পাঠকের মতামত: