॥ জহিরুল ইসলাম ॥ ৫ ডিসেম্বর, ১৯৮৭ সাল। এই দিনে স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনে চকরিয়ায় পুলিশের গুলিতে দৌলত খাঁন শহীদ হয়েছিল। দৌলত খাঁন এতদাঞ্চলে স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনে একমাত্র শহীদ ছাত্রনেতা। তিনি অবিভক্ত চকরিয়া উপজেলা জাতীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। ৫ ডিসেম্বর সারা দেশে ৮ দলীয় জোট, ৭ দলীয় জোট ও ৫ দলীয় বাম জোট উপজেলা ঘেরাও কর্মসূচী ঘোষণা করে। ওই ঘেরাও কর্মসূচীতেই চকরিয়ায় স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনের আপোষহীন ছাত্রনেতা শহীদ দৌলত খান পুলিশের গুলিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পথ সুপ্রশস্ত করেন। ওই দিন থেকেই আমরা স্বৈরাচার পতন আন্দোলন আরও বেগবান করে তোলার জন্য শ্লোগান দিয়েছি ‘রক্তে লেখা আরেক নাম, বিপ্লবী দৌলত খাঁন’। আন্দোলন চাঙ্গা করতে স্বৈরাচার এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে এই শ্লোগান দিয়েছি। শহীদ দৌলত খানসহ স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনে নিহত শহীদদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনে আপোষহীন ছাত্রনেতা শহীদ দৌলত খাঁনের অবদান ধরে রাখতে কী করতে পেরেছি এই প্রশ্ন অনেকের মাঝে রয়েছে। আজকের এইদিনে আমার সেই প্রিয় সহযোদ্ধা ছাত্রনেতা স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনের প্রতীক শহীদ দৌলত খাঁনকে স্মরণ না করলে অকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো। তাই শহীদ দৌলত খান স্মরণে স্মৃতি চারণ মূলক আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
১৯৮৭ সালের ৫ ডিসেম্বর ৮ দলীয় জোট, ৭ দলীয় জোট ও ৫দলীয় বাম জোট সারা দেশে উপজেলা ঘেরাও কর্মসূচী ঘোষণা করে। এই কর্মসূচী সফল করার জন্য ৪ ডিসেম্বর রাতে চকরিয়ায় জোটের লিয়াজো কমিটির নেতৃবৃন্দ একটি বৈঠকে বসেন। চকরিয়া সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে রাস্তায় এদিন রাত ৮টার দিকে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, ৮দলীয় জোটের পক্ষে এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, এ্যাডভোকেট মমতাজুল ইসলাম, মাষ্টার আবুল হাসেম বিকম, শফিউল কাদের শফি, ৭ দলীয় জোটের পক্ষে এ্যাডভোকেট ইলিয়াছ আরিফ, এনামুল হক, আবুল হাসেম, ৫দলীয় বাম জোটের পক্ষে কমরেড় নুরুল আবছার, হাজী বশিরুল আলম, জাফর আলম এম, ডা. জামাল উদ্দিন, মুজিবুল হক বিএসসি, জাফর আলম। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে এস এম জাহাঙ্গীর আলম, সরওয়ার আলম, দৌলত খাঁন, জহিরুল ইসলাম, আইয়ুব খাঁন( আলী কদম), লুৎফুল কবির, এম আর চৌধুরী, আমিনুর রশিদ দুলাল, জামাল উদ্দিন জয়নাল, মোঃ জাকারিয়া, গিয়াস উদ্দিন সহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ৫ ডিসেম্বর সম্মিলিত ভাবে কেন্দ্রীয় ভাবে ঘোষিত উপজেলা ঘেরাও কর্মসূচী পালন করা হবে। ৫ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল সহকারে ছাত্রজনতা মিলে চকরিয়া উপজেলা চত্বরে গিয়ে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠক করার সময় জরুরী অবস্থা জারি থাকায় বৈঠক শেষে রাতে যে যার মতো করে চলে যান।
পরদিন ৫ ডিসেম্বর আমরা দৌলত খান সহ সকাল ১০টার দিকে চিরিঙ্গা বাণিজ্যিক কেন্দ্রের হাশেম ষ্টোর, লিটন ক্লথ ষ্টোরের সামনে জড়ো হই। কিছুক্ষণের মধ্যে চকরিয়া থানার একদল পুলিশ আমাদের সামনে দিয়ে চিরিঙ্গা মহা সড়ক হয়ে উত্তর দিকে ছুটে যায়। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম চকরিয়া কলেজ থেকে একটি মিছিল আসবে, ওই মিছিলটি আসলেই আমরা চকরিয়া উপজেলা চত্বরের দিকে রওনা হয়ে যাবো। চকরিয়া কলেজ থেকে রুস্তম শাহরিয়ার, আমিনুর রশিদ দুলাল, ফরিদুল আলম, জয় শংকর চৌধুরী, খানে আলম, ইউসুপ রাজা, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক( বর্তমানে কবি মানিক বৈরাগী ), আতিক উদ্দিন চৌধুরীসহ কলেজ ছাত্রদের মিছিলটি মাতামুহুরী ব্রীজে পৌঁছলে সেখানে জাতীয় ছাত্রলীগের সরওয়ার আলম, নুরুল আবছার, বশির আহমদ, আইয়ুব রাজু, খালেদুল ইসলাম’র নেতৃত্বে আরও একটি মিছিল গিয়ে যোগ হয়। মিছিলটি চিরিঙ্গা পুরাতন বাস ষ্টেশনে পৌঁছলে একদল পুলিশ মিছিলকারীদের ধাওয়া দেয়। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে চকরিয়া থানার এসআই আবুল কালামের নেতৃত্বে পুলিশ আমিনুর রশিদ দুলাল, শাহ আলম(বদরখালী), খালেদুল ইসলাম (এসএমচর)কে গ্রেফতার করে। আমরা তখন চকরিয়া কলেজ থেকে আসা মিছিলে যোগ দেয়ার জন্য চিরিঙ্গা হাশেম ষ্টোর, লিটন ক্লথ ষ্টোরের সামনে জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। লিটন ষ্টোরের সামনে আমাদের সাথে দৌলত খানও ছিলেন। চিরিঙ্গা পুরাতন বাস ষ্টেশন থেকে গ্রেফতারকৃত ছাত্র নেতাদের থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে হাশেম ষ্টোর, লিটন ক্লথ ষ্টোরের সামনে জড়ো হওয়া ছাত্রজনতাকে ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আমাদেরকে চিরিঙ্গা পুরাতন বিমান বন্দর পর্যন্ত ধাওয়া দিয়ে নিয়ে যায়। লিটন ক্লথ ষ্টোরের সামনে থেকে পুলিশ বাকশালের চকরিয়া উপজেলা সহসভাপতি মাষ্টার আবুল হাশেম বিকম, ছাত্রনেতা ইয়াহিয়া খান কুতুবী, মোঃ জাকারিয়া, জিল্লুর রহমান ও সেলিম রেজা(কাকারা)কেও গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনার আগেই চকরিয়া কলেজ থেকে একটি মিছিল জামাল উদ্দিন জয়নালের নেতৃত্বে চকরিয়া কোর্ট এলাকায় গিয়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়। দুপুর পৌন ১২টার দিকে এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে ছাত্রজনতা চকরিয়া উপজেলা চত্বরে ঘেরাও কর্মসূচীতে অংশ নেন। দুপুর ১২টার দিকে চকরিয়া কোর্টের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে এ্যাডভোটে আমজাদ হোসেন, ছাত্রনেতা এস এম জাহাঙ্গীর আলম বুলবুল ও সরওয়ার আলম বক্তব্য রাখেন। এসময় ছাত্রনেতা জামাল উদ্দিন জয়নাল ও মোঃ আলমগীর চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে একটি মিছিল উপজেলা চত্বরে ঢুকে যায়। ওই মিছিলের অগ্রভাগে ছিল ছাত্রনেতা শহীদ দৌলত খান। সাথে সাথে পুলিশের গুলির শব্দ শোনা যায়। ছাত্রজনতা দিকবেদিক ছোটাছুটি শুরু করে। উপজেলা চত্বরের দক্ষিণ পাশে বিএডিসি বিল্ডিংয়ের সামনে অবস্থিত দৌলত খান কে লক্ষ্য করে পুলিশ রাইফেলের গুলি ছুড়ে। পুলিশের গুলি দৌলত খানের বুক বিদ্ধ করে পেছনের দিকে বের হয়ে যায়। সাথে সাথে দৌলত খান মাটিতে লুটে পড়েন। সেখান থেকে জামাল উদ্দিন জয়নাল, এম আর চৌধুরী, রুস্তম শাহরিয়ার, লুৎফুল কবির, একেএম শাহাব উদ্দিন (বর্তমানে চকরিয়া কলেজের অধ্যাপক), আনোয়ারুল আজিম(বদরখালী)সহ আরো কয়েকজন ছাত্রনেতা গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত দৌলত খানকে উদ্ধার করে আশংকাজনক অবস্থায় মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রীস্টান হাসপাতালে নিয়ে যান। মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রষ্টান হাসপাতালে অনেকেই রক্ত দেয়ার জন্য ছুটে যান। মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রীস্টান হাসপাতালে গিয়েও পুলিশ হামলা চালায়। সেদিন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে দৌলত খান আমাদের সকলকে কাদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যায়। পরে পুলিশ গিয়ে শহীদ দৌলত খানের লাশও কেড়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। পরদিন সকালে পুলিশ পাহারায় শহীদ দৌলত খানের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তার নিজ এলাকা চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের পশ্চিম কোনাখালী গ্রামে। সেখানে নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানে নামাজে জানাজা শেষে তাকে চির শায়িত করা হয়। সেই থেকে আমরা প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বরকে শহীদ দৌলত দিবস হিসাবে পালন করে আসছি। এদিনটি আসলেই শহীদ দৌলত খানের কবর জিয়ারত, কোরানখানী, খাবার বিতরণ, আলোচনা সভা এসব আনুষ্ঠানিকতা করে থাকি। শহীদ দৌলত খান স্মৃতি সংসদের সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর আলম বুলবুল জানান, আজকেও(৫ ডিসেম্বর) শহীদ দৌলত খান স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে কোনাখালীতে সকালে কোরানখানী, মিলাদ মাহফিল, কবর জিয়ারত, কালো ব্যাজ ধারণ, মোনাজাত, তবরুক বিতরনের কর্মসূচী রয়েছে। স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনের সবেক ছাত্রনেতা সরওয়ার আলমের উদ্যোগে একই ধরণের কর্মসূচীর কথা রয়েছে শাহারবিল ইউনিয়নের রামপুরে। চকরিয়ার প্রাক্তন ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে এদিন বিকালে চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠে আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল, খতমে কোরানের আয়োজন করার কথা রয়েছে। শহীদ দৌলত খেোনর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরীর মাঠকে ইতিপূর্বে দৌলত ময়দান ঘোষণা করা হয়েছে। চকরিয়া থানা রাস্তার মাথা থেকে চকরিয়া কোর্ট পর্যন্ত সড়ককে শহীদ দৌলত খান সড়ক নাম করণ করা হলেও তা অনেকেই জানেন না। সড়কের পাশের দাকানপাট, সরকারী প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর বিল বোর্ডে তা লিখাও হয় না। অন্য কোথাও লেখা হয় কিনা তা অন্তত আমার জানা নেই। এ ছাড়া শহীদ দৌলত খানের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য চকরিয়ায় আমরা উল্লেখযোগ্য তেমন আর কিছুই করতে পারিনি। এই না পারার দায়ভার আমাদের সকলের। তোমার রেখে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের প্রতিও যথাযথ কিছু করা হয়নি। এখন তারা কে কোথায় আছে তার কেউ খোঁজ খবর রাখে মনে হয় না। শুধু ৫ ডিসেম্বর আসলেই কিছু আনুষ্ঠানিকতা। তুমি শুধুই আমার রাজপথের সহযোদ্ধাই নয়, তুমি আমার ছোটবেলার বন্ধুও, তুমি পারলে আমাদের ক্ষমা করিও। বিনম্র শ্রদ্ধা তোমার প্রতি। যেখানেই আছো শান্তিতে থাকো। এখানে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে শুধু তারাই নয়, আরও অগনিত ছাত্র জনতা, ছাত্র, যুবক আমাদের সাথে রাজপথ কাপিয়ে মিছিল করেছে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলন ৫ ডিসেম্বর শহীদ দৌলত খানের আত্মদানের মাধ্যমে বেগবান হয়েছে, তীব্রতা পেয়েছে। কিন্তু এ আন্দোলন তো আরো আগে থেকপ চলে আসছিল। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার সরকারের পতন পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছাড়েনি। এখানে অসংখ্য নেতাকর্মী আমাদের সহযোদ্ধা ছিল। সেইসব সহযোদ্ধাদের অবদান কোনদিন ভুলার নয়। তাদের সকলের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবী কার কাছে করবো জানিনা। তবে তাদের একটি সঠিক তালিকা করে তা প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে। এইটুকু হলেও যদি করা যায় তাহলে অন্তত মানুষ ইতিহাসটি জানতে পারবে। ভুল হলে ক্ষমার আর্জিটুকু করে রাখলাম।
পাঠকের মতামত: