এসব প্রত্যয়নপত্র ও জাতীয়তা সনদ দিয়ে করা হচ্ছে বাংলাদেশি পাসপোর্টের আবেদন
ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়ার দুজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আশ্রিত মিয়ানমার নাগরিকদের ‘রোহিঙ্গা নয়’ মর্মে প্রত্যয়নপত্র এবং জাতীয়তা সনদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চেয়ারম্যানের কাছ থেকে এমন প্রত্যয়নপত্র ও জাতীয়তা সনদ দিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য আবেদনও করেছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা। কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে করা আবেদনের সঙ্গে জমা দেওয়া কাগজপত্র যাচাইয়ের সময় বিষয়টি জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) কর্মকর্তাদের নজরে আসে। এ নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলছে।
ডিএসবি সূত্রে জানা যায়, চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী ও ডুলাহাজারা ইউনিয়নের বাসিন্দা তথা বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে পাসপোর্ট পেতে আবেদন করা তিন মিয়ানমার নাগরিককে রোহিঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত করে এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন ডিএসবি কর্মকর্তারা। রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত হওয়া ওই তিন রোহিঙ্গার কাগজপত্রও চকরিয়া নিউজ’র হাতে এসেছে।
মিয়ানমার নাগরিককে ‘রোহিঙ্গা নয়’ মর্মে প্রত্যয়নপত্র এবং জাতীয়তা সনদ দেওয়া ইউপি চেয়ারম্যানরা হলেন চকরিয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী এবং উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন। এ ছাড়া খুটাখালীসহ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, গভীরভাবে তদন্ত করলে এসবের সত্যতা বেরিয়ে আসবে।
ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী গত ২৯ এপ্রিল মোহাম্মদ নুরুল হোসেন নামে এক রোহিঙ্গাকে স্থায়ী বাসিন্দা এবং ‘রোহিঙ্গা নয়’ মর্মে প্রত্যয়নপত্র দেন। এর আগের দিন নুরুল হোসেনকে দেওয়া হয় জাতীয়তা সনদও। প্রত্যয়নপত্র ও জাতীয়তা সনদ দুটিতে চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর সিল ও সই রয়েছে। নুরুল হোসেনের পাসপোর্ট আবেদনের কাগজপত্র যাচাই শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে ডিএসবি চকরিয়া জোনের ডিআইও মো. মানিক মিয়া উল্লেখ করেন, নুরুল হোসেনের পাসপোর্ট আবেদনে উল্লিখিত তথ্য সঠিক নয়। এ রকম প্রেক্ষাপটে ডিএসবির এই কর্মকর্তা নুরুলকে পাসপোর্ট না দেওয়ার পক্ষে মত দেন।
ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ঘুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা সেজে পাসপোর্ট পেতে আবেদন করেন মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। তাঁর আবেদন যাচাই শেষে পুলিশ প্রতিবেদন বিশেষ শাখায় জমা দেন ডিএসবির এএসআই মো. আবদুল মান্নান। ওই কর্মকর্তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরেজমিন তদন্তের সময় প্রার্থীকে ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া গেলেও আবেদনে উল্লিখিত তাঁর বাবার বাংলাদেশি নাগরিকত্বের কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। এ রকম প্রেক্ষাপটে ইউসুফকে পাসপোর্ট না দেওয়ার পক্ষে মত দেন ওই কর্মকর্তা। ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ইউসুফ আলীকেও ‘রোহিঙ্গা নয়’ মর্মে প্রত্যয়নপত্র এবং জাতীয়তা সনদ দিয়েছিলেন। এর আগে এ ধরনের ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ভোটার তালিকায়ও নাম লিখিয়েছিলেন ইউসুফ।
এদিকে ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ডুমখালী গ্রামের বাসিন্দা দেখিয়ে ‘রোহিঙ্গা নয়’ মর্মে প্রত্যয়নপত্র এবং জাতীয়তা সনদ দেওয়া হয়েছে মিয়ানমার নাগরিক সোলতান আহমদের ছেলে জয়নাল উদ্দিনকে। সেই প্রত্যয়নপত্র ও জাতীয়তা সনদ দিয়ে তিনি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন গত ২৩ ফেব্রুয়ারি। জয়নালের সেই পাসপোর্ট আবেদন যাচাই করে প্রতিবেদন জমা দেন ডিএসবি চকরিয়া জোনের এডিআইও মো. আল আমিন। পুলিশের বিশেষ শাখায় জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ডিএসবির এই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, কাগজপত্র যাচাই ও গোপনে তদন্তের সময় প্রার্থী জয়নালের পরিবারের সব সদস্য মিয়ানমারের নাগরিক বলে স্থানীয় সবাই তথ্য দেন।
এ ব্যাপারে ডিএসবি কর্মকর্তা মো. আল আমিন বলেন, ‘পাসপোর্ট পেতে আবেদনকারী জয়নাল এক বছরেই দুবার আবেদন করেছেন। প্রথমবারের আবেদনে তিনি রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত হওয়ার পর তাঁর আবেদন বাতিল করা হয়। এর এক বছরের মাথায় ফের আবেদন করেন জয়নাল। দ্বিতীয়বারের তদন্তেও জয়নালসহ পরিবারের সব সদস্যকে রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত করা হয়।’
ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ডুমখালী এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা দাবি করেন, কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ডুলাহাজারা বন বিটের ডুমখালী ছাড়াও ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় সংরক্ষিত বনভূমিতে কয়েক শ রোহিঙ্গার বসতি গড়ে উঠেছে। গেল কয়েক বছরের মধ্যেই সেখানে মিয়ানমারের অসংখ্য রোহিঙ্গা পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনসহ তাদের বাংলাদেশি নাগরিক প্রমাণে জাতীয়তা সনদ, জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিতে সহায়তা করেছেন। এর বিনিময়ে তাঁরা হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
জয়নাল উদ্দিনের দাদা নূর আহমদ রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করেছেন ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আমিন। এর পরও জয়নালকে ‘রোহিঙ্গা নয়’ মর্মে প্রত্যয়নপত্র ও জাতীয়তা সনদ দেওয়ার বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাঁরা এখন ভোটার হয়ে গেছেন। তাই ‘রোহিঙ্গা নয়’ মর্মে প্রত্যয়ন ও জাতীয়তা সনদ দেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁদের আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
এদিকে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্য নেওয়ার জন্য কয়েকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সংযুক্ত হননি।
কক্সবাজারে ভোটার তালিকায় হাজারো রোহিঙ্গা : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওয়ান-ইলেভেনের পর প্রথমবারের মতো ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয় সারা দেশে। ওই সময় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়ার ২৫টি ইউনিয়নে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা হালনাগাদ ভোটার তালিকায় ঢুকে যান। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন জনপ্রতিনিধিরা। পরে মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়লে সরকার ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিক এবং মিয়ানমার নাগরিক শনাক্ত করতে বিশেষ একটি ফরম পূরণের ওপর কঠোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। সেই বিশেষ ফরমের কারণে অনেক রোহিঙ্গা হালনাগাদ ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে না পারলেও পরে টাকার বিনিময়ে জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে তালিকায় নাম ওঠান বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তেও উঠে আসে।
নাম প্রকাশ না করার শর্ত চকরিয়ার সাবেক এক নির্বাচন কর্মকর্তা চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘তখন আমাদের কিছুই করার ছিল না। কারণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহসহ ভোটার আবেদন ফরম বাড়িতে বসেই পূরণ করেছেন তথ্য সংগ্রহে নিয়োজিতরা। আর আবেদনের সঙ্গে ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান রোহিঙ্গারা।’এই নির্বাচন কর্মকর্তা মনে করেন, বিশেষ ফরম না থাকার সুযোগে আগে যেসব রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন, তাঁদের বাদ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ জন্য সরকার বা নির্বাচন কমিশন পরিকল্পিতভাবে একটি ক্রাশ প্রগ্রাম হাতে নিতে পারে। তাহলেই রোহিঙ্গামুক্ত হতে পারে ভোটার তালিকা।’
পাঠকের মতামত: