ঢাকা,রোববার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

খোলা চোখ-জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ আদায় প্রক্রিয়া

dddddস.ম.ইকবাল বাহার চৌধুরী / আবু বক্কর ছিদ্দিক ::

 বাংলাদেশ সরকারের ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান ২০১০’ অনুসারে মহেশখালী দ্বীপটিকে ঘিয়ে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা। এই দ্বীপটিকে ‘পাওয়ার হাব’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ইতিমধ্যে পরিকল্পিত ও সমন্বিত উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য দ্বীপের ভূমি ব্যবহারের একটি ‘লে-আউট প্ল্যান‘ প্রস্তুত করার কাজও শুরু হয়েছে বলে জানা যায়। এখানে গড়ে তোলা হচ্ছে ৪টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন যেখানে স্থাপন করা হবে একাধিক কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং গ্যাস ও জ্বালানী তেলে ডিপো। ইতিমধ্যে এইসব প্রকল্পের জন্য এই উপজেলায় বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে উন্নয়ন কাজে জমি অধিগ্রহণ সব সময় জটিল এবং বিরোধপূর্ণ। প্রায়শই আমরা জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে সরকার এবং জমির মালিকদের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াতে দেখি। এই জটিলতা সৃষ্টির পিছনে দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত: সরকারের পক্ষ হতে জমি অধিগ্রহণের আইনি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ না করা; দ্বিতীয়ত: জমি অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রক্রিয়া জানা না থাকা। জমি অধিগ্রহনের ক্ষতিপূরণ আদায়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে প্রায়শই ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হতে হয়। এই প্রবন্ধে সরকারিভাবে জমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের পূরণ আদায়ের প্রক্রিয়ার বিষয়ে একটি ধারণা দেওয়া হবে।

 প্রথমত জেনে রাখা দরকার উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নে রাষ্ট্র আইন অনুসারে ব্যক্তি মালিকানাধীন বা দখলাধীন জমি অধিগ্রহণ করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে বেসরকারি সম্পত্তি গ্রহণের জন্য ‘স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ১৯৮২’ অনুসরণ করা হয়। ‘স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ১৯৮২’ আইনে অধিগ্রহণ করা স্থাবর সম্পত্তির মালিককে কিছু সুবিধাদি প্রদান করা হয়েছে। যেমন; এই আইনে অধিগ্রহণের বিষয়ে জমির মালিকের আপত্তি তোলার সুযোগ আছে এবং আইনানুসারে এইসব আপত্তি নিষ্পত্তি করারও বিধান আছে। জমির হুকুম দখল প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমানোর জন্য ভূমি অধিগ্রহণের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আইনানুসারে ডেপুটি কমিশনার ৮ ও ৯ ধারা মোতাবেক ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করবেন এবং প্রযোজ্য ক্ষতিপূরণ প্রদান বা সরকারি ট্রেজারিতে গচ্ছিত রাখা সাপেক্ষে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করবেন। ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরনের সাথে ৫০% অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়। অধিগ্রহণকৃত জমি যে উদ্দেশ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এই আইন অনুসরণের ব্যত্যয় লক্ষ্য করি। বিশেষত জনগণের উপত্তি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মনোযোগি হতে দেখা যায় না। অন্যদিকে প্রকল্পের বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের সাথে খোলামেলা আলোচনার চর্চাও দেখা যায় না। একভাবে বল প্রয়োগের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়; যার ফলে প্রতিটি প্রকল্পের জমি অধিগ্রহনের ক্ষেত্রে গণঅসন্তোষ লক্ষ্য করা যায়।

 জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিয়েও অস্পষ্টতা রয়েছে। ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আইনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল অধ্যাদেশ ১৯৮২ অনুসারে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে: (ক) ৩ ধারার নোটিশ জারির দিনে সম্পত্তির বাজার মূল্য (বাজার মূল্য নির্ধারণের সময় জেলা প্রশাসক একই পারিপার্শ্বিক সুবিধাযুক্ত সম্পত্তির বিগত বার মাসের গড়পড়তা মূল্য বিবেচনা করবেন); (খ) দখল গ্রহণের সময় ঐ সম্পত্তির উপর বিদ্যমান শস্য বা বৃক্ষ গ্রহণের ফলে ক্ষতি; (গ) সম্পত্তি হতে পৃথককরণজনিত কারণে ক্ষতি; (ঘ) বাসস্থান বা কর্মস্থল স্থানান্তরে বাধ্য হলে স্থানান্তরের জন্য আনুষঙ্গিক খরচ; (ঙ) ৬ ধারার নোটিশ জারি এবং জেলা প্রশাসক কর্তৃক দখল গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে সম্পত্তির মুনাফা হ্রাসের ফলে যে ধরনের ক্ষতি; (চ) জোরপূর্বক অধিগ্রহণ বিবেচনায় বাজার মূল্যের উপর আরও পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষতিপূরণ প্রদান। এছাড়া ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ এবং প্রদানের ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্পে যেসব প্রতিষ্ঠান অর্থ সহায়তা দেয় এবং যেসব প্রতিষ্ঠান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে তাদের নিজস্ব কিছু নির্দেশিকা রয়েছে যা বিদ্যমান আইনের সাথে সমন্বয় সাধন করে প্রতিপালন করা হয়। যেমন মাতারবাড়ি প্রকল্পের অর্থ সহায়তাকারী সংস্থা হিসেবে রয়েছে জাইকা, যাদের ভূমি অধিগ্রহণ এবং পুনর্বাসন সংক্রান্ত একটি নির্দেশিকা বা নীতিমালা রয়েছে যা ঔওঈঅ এঁরফষরহব ভড়ৎ ঊহারৎড়হসবহঃষধ ধহফ ঝড়পরধষ ঈড়হংরফবৎধঃরড়হং ২০১০ নামে পরিচিত। জাইকা নির্দেশনা অনুসারে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার উপযুক্ত মানুষের ধরন বাংলাদেশ সরকারের অধ্যাদেশ থেকে আরো অধিক। এই কর্ম পরিকল্পনায় অনৈচ্ছিক পুনর্বাসনের জন্য তিনটি উপাদানকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়। জাইকা নির্দেশিকা মতে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার উপযুক্ত মানুষের মধ্যে আছে: (১) সম্পত্তি, আয়ের উৎস এবং জীবিকা নির্বাহের সংগতি হারানো এবং ভূমির উপর আইনি দাবিহীন কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত এমন মানুষের ক্ষতিপূরণ; (২) স্থানান্তরের স্থান এবং যথোপযুক্ত সুবিধাদিসহ স্থানান্তরের জন্য আর্থিক সহযোগিতা এবং(৩) অন্ততপক্ষে বর্তমান অবস্থার সমপর্যায়ে পুনর্বাসন করা।

 জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে অনুসৃত প্রক্রিয়াসমূহ

 ১. অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে নোটিশ প্রেরণ: সরকার কোন প্রকল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলে জেলা প্রশাসক জমি অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল অধ্যাদেশ ১৯৮২ অনুসারে সম্পত্তি অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে খতিয়ান অনুসারে জমির মালিককে প্রাথমিক নোটিশ (৩ ধারা নোটিশ) জারি করে। ৩ ধারার নোটিশ জারির পর ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ ডেপুটি কমিশনার বরাবর ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে তাদের আপত্তি উত্থাপন করতে পারে। আপত্তি নিষ্পত্তি হলে জেলা প্রশাসন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি ক্ষতিপূরণ প্রদানের নোটিশ (৬ ধারার নোটিশ) জারি করে। সর্বশেষ জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের নোটিশ (৭ ধারা নোটিশ) জারি করে। ৭ ধারার নোটিশের পর জেলা প্রশাসন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণে প্রযোজ্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আইনানুসারে ৭ ধারা নোটিশ জারির পর উন্নয়ন কাজ শুরু করা যায়; এজন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান নিশ্চিত করার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি দাখিলের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায় করা জমির মালিকদেও দায়িত্ব।

 ২. ক্ষতিগ্রস্ত কর্তৃক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ফাইল প্রস্তুতকরণ: ৭ ধারার নোটিশ জারির অর্থ নোটিশকৃত জমির মালিক জেলা প্রশাসক। নোটিশকৃত জমির মালিকগণ প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি দাখিলের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবীর আইনগত ভিত্তি লাভ করেন। ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য যেসব প্রমাণাদি প্রয়োজন হয় তার মধ্যে আছে; (১) স্থানীয় চেয়ারম্যানের কর্তৃক সত্যায়িত ছবি, (২) নাগরিকত্ব সনদ, (৩) বিএস খতিয়ানের মূল/সার্টিফাইড কপি, (৪) হাল সনের খাজনা দাখিলা, (৫) ওয়ারিশ সনদপত্র, (৬) রোয়েদাদনামা, (৭) ক্ষমতাপত্র (নাদাবিপত্র), (৮) বণ্টননামা, (৯) হস্তান্তরিত দলিল (১০) ৭ ধারা নোটিশে উল্লেখিত ক্ষতিপূরণের প্রমানাদি।

 ৩. ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ফাইল জমাকরণ: প্রয়োজনীয় তথ্যাদিসহ ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় ফাইল জমা দিতে হয়। ফাইল জমাকরণের পর একটি রেজিস্ট্রার বুকে ক্ষতিপূরণ গ্রহণকারীর নাম, খতিয়ান নম্বর, ৭ ধারা নোটিশের রোয়েদাদ এবং জমির পরিমাণ লিখে একটি সিরিয়াল নম্বর দেয়া হয়। এই সিরিয়ার নম্বর অনুসারে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা হয়।

 ৪. ক্ষতিপূরণের দাবির বিষয়ে সার্ভেয়ার/কানুনগোর প্রতিবেদন: দাখিলকৃত ক্ষতিপূরণ দাবির ফাইলের সত্যতা ও রোয়েদাদের সত্যতা যাচাইপূর্বক ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার ও কানুনগো প্রতিবেদন প্রদান করে। জমির মালিকানা, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এবং নাদাবিপত্রসহ সব কিছু যাচাই করার পর এই প্রতিবেদন দেয়া হয়। সার্ভেয়ার এবং কানুনগোর প্রতিবেদনে যদি দাবিকৃত ফাইলের তথ্যাদি সত্য বলে বিবেচিত হয় তাহলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আর কোন আইনি বাধা থাকে না। সার্ভেয়ার ও কানুনগো প্রতিবেদনে কোন আপত্তি থাকলে সে অনুযায়ী পরবর্তী তথ্যাদি দাখিল করতে হয়।

 ৫. আরবিট্রেশন সমাধানে মিস কেস: সার্ভেয়ার ও কানুনগোর প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে জমির মালিকানা কেন্দ্রিক বা অন্য কোন ধরনের জটিলতা থাকলে এডিসি রেভিনিউ বরাবর মিস কেসের মাধ্যমে তা সমাধান করতে হয়। মিস কেসের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে যে কোন আরবিট্রেশন সমাধান করার নিয়ম রয়েছে।

 ৬. ক্ষতিপূরণের চেক প্রদান: সার্ভেয়ার ও কানুনগোর প্রতিবেদন সাপেক্ষে দাখিলকৃত ফাইল ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির উপযুক্ত বিবেচিত হলে ক্ষতিপূরনের চেক প্রদান করা হয়।

 ৭. ক্ষতিপূরণের চেকে এডভাইস গ্রহণ: গৃহীত ক্ষতিপূরণের চেক দ্বারা টাকা উত্তোলন করতে চেকের উপর এডিসি রেভিনিউ কর্তৃক এডভাইস প্রয়োজন হয়।

 ৮. এডভাইস প্রাপ্ত চেকে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার অনুমোদন: এডিসি রেভিনিউ’র এডভাইস প্রাপ্ত চেকের উপর ট্রেজারি শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদানের পর ঐ চেক টাকা উত্তোলনের জন্য উপযুক্ত হয়।

 ৯. ব্যাংকে চেক জমা দান: হিসাব রক্ষক কর্মকর্তার চূড়ান্ত অনুমোদন প্রাপ্ত চেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসেবে জমা দিলে ঐ নির্দিষ্ট হিসাবে টাকা জমা হয়।

 যে কোন ধরনের অস্পষ্টতা নিরসনে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল অধ্যাদেশ ১৯৮২ অনুসরণ করতে হবে। জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও হয়রানি রোধকল্পে সরকার এবং জনগণের পক্ষে বিদ্যমান আইন অনুসরণের কোন বিকল্প নাই। উভয় পক্ষ যথাযথ প্রক্রিয়ায় আইন অনুসরণ করলে হয়রানি ও দুর্নীতি হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।

পাঠকের মতামত: