ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

সিডিউল লঙ্ঘনে ঢালাইকাজে ব্যবহার হচ্ছে বাংলা রড

কাকারা তাজুল উলুম মাদরাসায় ৩কোটি টাকার একাডেমিক ভবন নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দূর্নীতি

All-focus

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া :: চকরিয়া উপজেলায় এবার শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের অর্থায়নে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন ভবন নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। কার্যাদেশ অনুযায়ী সরকারি বিপুল টাকা বরাদ্দে বিদ্যালয় ও মাদরাসার নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণকাজে উন্নতমানের রড ও সিলেটি বালু ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সমুহ তা যতেষ্ঠ লঙ্ঘন করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল লোকজন।

ইতোমধ্যে চকরিয়া উপজেলার কাকারা ইউনিয়নে তাজুল উলুম মাদরাসার চারতলা বিশিষ্ট নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণকাজে বড়ধরণের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। কার্যাদেশ অনুযারী ভবন নির্মাণে উন্নতমানের রড ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও ভবনটির নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল বাংলা রড। ঘটনাটি আঁচ করতে পেরে এলাকাবাসি আপত্তি তুলে। পরে অবশ্য শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারি প্রকৌশলী রাসেল চৌধুরী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বাংলা রড ব্যবহার করে ভবন নির্মাণে বাঁধা দেন। এরপর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ঢালাই কাজে লাগানো বাংলা রড গুলো খুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

কক্সবাজার শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ সুত্র জানায়, চলতি অর্থবছর চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ৬টি মাদরাসা ও ১১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চারতলা বিশিষ্ট আধুনিকমানের নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়াও ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজসহ এবং সেকেণ্ডারী স্কুল ইমপ্লিমেন্টেশন প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বছরের প্রথমদিকে শুরু হয়েছে।

তৎমধ্যে ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা বরাদ্দে উপজেলার কাকারা ইউনিয়নে তাজুল উলুম মাদরাসা এবং একই পরিমাণ অর্থবরাদ্দে ডুলাহাজারা মারূফিয়া মাদরাসার নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজ পেয়েছেন চট্টগ্রামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মের্সাস তৌহিদ এন্ড বার্দ্রাস। প্রতিষ্ঠানটির মালিক পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা আহমেদ কবির চৌধুরী।

অপরদিকে ৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দে চকরিয়া উপজেলার আমজাদিয়া রফিকুল উলুম ফাজিল মাদরাসার চার তলা বিশিষ্ট নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজটি পেয়েছেন কক্সবাজারের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স দীপঙ্কর বড়ুয়া। চলতিবছরের ফেব্রুয়ারী মাসে কার্যাদেশ পেয়েই কাজ শুরু করেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সমুহ। আর তিনটি মাদরাসার নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজ গুলো আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কক্সবাজার-১ আসনের সাংসদ ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম।

কাকারা তাজুল উলুম মাদরাসার একাডেমিক ভবন নির্মাণকাজে অনিয়মের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন মাদরাসা কমিটির সভাপতি ও কাকারা ইউপি চেয়ারম্যান শওকত ওসমান। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারী মাসে নির্মাণকাজ শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে করোনা সংক্রমণের কারণে কয়েকমাস কাজ বন্ধ থাকে। এই সুযোগে সম্প্রতি সময়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আমাদেরকে কিছু না জানিয়ে তড়িগড়ি করে কাজ শুরু করেন। পরে দেখি ভবনের চাদ ঢালাই কাজে উন্নতমানের রডের বদলে দেওয়া হচ্ছিল বাংলা রড।

তিনি বলেন, ঘটনাটি জানতে পেরে আমি শিক্ষাপ্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তাদেরকে জানাই। এলাকাবাসির আপত্তির মুখে কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে বাংলা রড ব্যবহার করে ভবন নির্মাণে বাঁধা দেন। এরপর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ঢালাই কাজে লাগানো বাংলা রড গুলো খুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

মাদরাসাপাড়ার বাসিন্দা স্ট্রবেরী চাষী রেজাউল করিম, ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম বাহাদুর, সমাজসেবক আবদুর রাজ্জাকসহ অনেকে দাবি করেন, ভবনের চাদ ঢালাই কাজে বাংলা রড ব্যবহারের ঘটনাটি সবাই দেখেছে। কিন্তু ইতোমধ্যে ভবনের নীচের অংশের বেইজ ঢালাই কাজ শেষ হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, চাদ ঢালাইয়ের মধ্যে নীচের বেইজ ঢালাই ও গাথুনিকাজে নিশ্চয় নিন্মমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। এ অবস্থায় মাদরাসার চারতলা বিশিষ্ঠ এই ভবনটির স্থায়ীত্ব নিয়ে আমাদের মতো এলাকাবাসিও সন্দিহানে রয়েছে।

এলাকাবাসির অভিযোগ নাচক করে স্থানীয় কাকারা ইউপি চেয়ারম্যান শওকত ওসমান ও কক্সবাজার শিক্ষাপ্রকৌশল অধিদপ্তর চকরিয়া উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারি প্রকৌশলী রাসেল চৌধুরী বলেন, চাদ ঢালাই কাজে বাংলা রড ব্যবহারের বিষয়টি প্রকাশ্যে ঘটেছে। সেইজন্য সবাই দেখেছে। তবে ভবনের নীচের অংশের বেইজ ও গাথুনির নির্মাণকাজে কোনধরণের অনিয়ম হয়নি। শতভাগ স্বচ্ছতার মাধ্যমে ভবনের গাথুনির কাজ নিশ্চিত করা হয়েছে।

সহকারি প্রকৌশলী রাসেল চৌধুরী বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন আমাদের অজান্তে মাদরাসা ভবনের চাদ ঢালাই কাজে বাংলা রড ব্যবহার করতে উদ্যোগ নেয়। অবশ্য ঢালাইয়ের আগে প্রকল্প ভিজিটকালে ঘটনাটি আমার কাছে ধরাপড়ে। তারপর বিষয়টি নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবগত করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে এসব রড চাদ থেকে খুলে নিতে বলি। তবে এখন উন্নতমানের রড (বায়োজিদ স্টীল) চাদ ঢালাই কাজে বসানোর কাজ করছেন ঠিকাদারের লোকজন।

জানতে চাইলে নির্মাণকাজে অনিয়মের বিষয়টি অবান্তর বলে দাবি করেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক আহমেদ কবির চৌধুরী। মুঠোফোনে তিনি বলেন, চাদ ঢালাই কাজে বাংলা রড ব্যবহার নিয়ে প্রশ্নের যোক্তিকতা নেই। কারণ এসব রড আগে কোয়ালিটি সম্পন্ন কী না তা দেখতে হবে। টেস্টে নিয়ে দেখার পর রডের ব্যাপারে প্রশ্ন আসলে বা নিন্মমানের রড ব্যবহার করার অপরাধে আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার পথ খোলা ছিল। কিন্তু সহকারি প্রকৌশলী রাসেল চৌধুরী তা না দেখে শুধুই রডের অজুহাতে নির্মাণকাজের স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ছুঁেড় দিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি ঠিকাদার। কাজই আমার পেশা। কিন্তু তিনি (সহকারি প্রকৌশলী) কাজের তদারক কর্মকর্তা। সেইক্ষেত্রে নির্মাণকাজে কোনধরণের অস্বচ্ছতার প্রশ্ন উঠলে দায়ভার কিন্তু তারও আছে। মুলত তিনি পছন্দের রড কোম্পানীর মাল নির্মাণকাজে ব্যবহারে বাধ্য করতে আমাদের উপর দায় চাপাচ্ছেন। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে হয়রাণি করছেন।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.কামরুল আহসান বলেন, কাকারা তাজুল উলুম মাদরাসা ভবনের চাদ ঢালাইকাজে বাংলা রড ব্যবহার করার বিষয়টি জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে তা খুলে নিতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দিই। কোয়ালিটি ভালো হোক, তবু এলাকাবাসি বা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ থাকলে সেইধরণের উপকরণ ব্যবহার হবেনা।

প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই মাদরাসা ভবনের নীচের অংশের বেইজ ঢালায় কাজে সিডিউল মোতাবেক উন্নতমানের উপকরণ ব্যবহার করেছেন ঠিকাদারী। মোটকথা ভবনের গাথুনি কাজে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাতে ভবনের স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্নের কোন অবকাশ নেই। এভারে চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ভবন নির্মাণকাজে দুর্নীতির লাগাম টানতে নজরদারি রাখা হয়েছে।

 

পাঠকের মতামত: