ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে জখমী সনদ জালিয়াতি, ডাঃ ছালামের বিরুদ্ধে অভিযোগেরই সব প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি

mail.google.comএম.শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার, ২৯ মার্চ ॥

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিপত্রের আদেশ লঙ্ঘন করে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক ডাঃ আবদুচ ছালাম কর্তৃক টাকার বিনিময়ে ভুয়া জখমী সনদ প্রদান ও জখমি সনদ জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে। তিনজন বা ২ জন মেডিকেল অফিসারের সমন্বয়ে বোর্ড গঠনের পর জখমীকে পরীক্ষা করে সনদ দেয়ার নিয়ম থাকলেও তিনি তা পদে পদে লঙ্ঘন করেছেন। তিনি নিজেই ২টি স্বাক্ষর জাল জালিয়াতি করে শতশত জখমী সনদ সরবরাহ করেছেন। সম্প্রতি আদালতে ভিকটিম কর্তৃক দাখিল করা এমনই একটি জখমী সনদ দেয়ার বিষয়ে আদালতের নির্দেশে তদন্ত করতে গিয়ে মেডিকেল অফিসারের স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সব কটিরই প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

জেলা সদর হাসপাতালের তিন জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন গত ১৯ মার্চ টেকনাফ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আমলী আদালতে দাখিল করা হয়েছে। ডাঃ আবদুচ ছালামের বিরুদ্ধে কর্তব্যরত একজন চিকিৎসকের স্বাক্ষর জালিয়াতি, বিধিবর্হিভুত জখমি সনদপত্র দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে আদালতে ।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফ থানায় দায়েরকৃত একটি মামলায় ( থানা মামলা নং-৬২,জিআর মামলা নং-৪৫০. তাং-২৭/৬/২০১৫) তত্ত্বাবধায়ক জেলা সদর হাসপাতাল কর্তৃক স্মারক নং-৫৮৭, তাং-৪/৫/২০১৫ইং মুলে প্রেরিত আমান উল্লাহ নামের এক ব্যক্তির দুইটি জখমি সনদে ডাক্তারের স্বাক্ষর ও ফরওয়ার্ড এবং ভিকটিম আমান উল্লাহর জখমি আঘাত ভিন্নতা মনে হওয়ায় আদালত এই সনদ দুটির বিষয়ে ব্যাখ্যা চান (কোটের আদেশ নামার স্মারক নং-১৬৮৩(২),তাং-২৯/৯/২০১৫ইং)।

আদালতের আদেশ হাতে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন সদ্য বদলীর আদেশ পাওয়া (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক হিসেবে) কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ রতন চৌধুরী। স্মারকনং-সুপার/কক্স/হাসপাতাল/তদন্ত/প্রশাঃ/,২০১৬/৮২,তাং-১৪/১/১৬)। হাসপাতালের আরএস ডাঃ টুটুল তালুকদার, জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মোঃ আয়ুব আলী ও তদন্ত বোর্ড সভাপতি ডাঃ পুচনু ( সহকারী পরিচালক) এর সমন্বয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

তিনি বলেন,‘আদালতের নির্দেশনা হাতে পেয়ে তিন সদস্যের তদন্ত বোর্ড গঠন করে তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে ডাঃ আবদুচ ছালামের বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশ অনুসারেই তদন্ত প্রতিবেদন (স্মারক নং-সুপার/কক্স/হাসপাতাল/তদন্ত/প্রশাঃ/,২০১৬/৮২,তাং-১৪/১/১৬/৪৪১,তাং-১৯/৩/২০১৬) দাখিল করা হয়েছে।’

অভিযোগে জানা যায়, ২৫০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতালের জরুরী চিকিৎসা কর্মকর্তা ডাঃ আবদুস ছালাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিপত্রের আদেশ পদে পদে লঙ্ঘন করে নিজেই কর্তব্যরত চিকিৎসক সেজে কখনো একাই দুটি স্বাক্ষর করে বা একটি স্বাক্ষর করে জালিয়াতির মাধ্যমে অহরহ মিথ্যা জখমী সনদ প্রদান করেন। অথচ একজনের স্বাক্ষরে সনদ দেয়ার কোন বিধান নেই। শুধুমাত্র রেজিস্ট্রার খাতার লিপিবদ্ধ করা জখমী নোটগুলো অনুসরণ না করে ভিকটিমের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা না করে ৩ সদস্যের স্থলে এক সদস্য হয়ে দুটি অন্য রকম স্বাক্ষর করে জখমী সনদগুলো দিয়ে আসছিলেন তিনি। যা ১০/১০/১৯৯৫ ইং তারিখের সংশোধিত পরিপত্রের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের একজন চিকিৎসক।

অভিযোগে আরো প্রকাশ, গত ১৭ মার্চ ডাঃ আবদুচ ছালাম কর্তৃক উখিয়া জালিয়াপালং ইউনিয়নের সোনাইছড়ি এলাকার রেশমা আকতার নামের এক নারীকে একটি জখমি সনদ সরবরাহ দেন। তিন সদস্যের বোর্ড গঠন করে জথমী সনদ দেয়ার নিয়ম না মেনে এই সনদে ডাঃ ছালাম একজনই একটি স্বাক্ষর করেন সনদটি সরবরাহ দিয়েছেন। যা বিধিবর্হিভুত ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট পরিপত্র পরিপন্থি। এই মিথ্যা জখমী সনদ নিয়েই ওই নারীর সাবেক স্বামী বেলাল আজাদ নামের একব্যক্তির বিরুদ্ধে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি আদালত আমলে নিয়ে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করেছেন। এধরনের মিথ্যা, জালিয়াতি জাল জখমী সনদ নিয়ে শতশত নিরীহ লোকজন মামলায় জড়িয়ে পড়ে জেলে রয়েছেন বলে জানা যায়।

তদন্ত বোর্ড সদস্য জেলা সদর হাসপাতালের আরএস ডাঃ টুটুল তালুকদার বলেন, টেকনাফ উপজেলার শাপলাপুর ইউনিয়নের মৃত রশিদ আহম্মদের ছেলে আমান উল্লাহ গত বছরের ২৬ জুন সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ মিনিটে জেলা সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে রেফার করা হয়। পরদিন একই ব্যক্তি আমান উল্লাহ জেলা সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে সকাল ৭টা ২০ মিনিটে পুরুষ সার্জারী বিভাগে ভর্তি হয় এবং একই দিন ২৭ জুন চিকিৎসা শেষে তাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২৮ জুন টেকনাফ মডেল থানার এসআই মোঃ সেকান্দর আলী জেলা সদর হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক বরাবর ভিকটিমের জখমি সনদ সরবরাহের জন্য আবেদন করেন।

তিনি আরো বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক কার্যালয় থেকে ভিকটিম আমান উল্লাহর ২টি জখমী সনদপত্রের সাথে ২টি ফরওয়াডিং এর চিঠি টেকনাফ থানা বরাবর প্রেরণ করা হয়। দখিলকৃত সনদপত্রের মধ্যে হাতের লেখা এবং আঘাতের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় এবং মেডিকেল বোর্ড কর্তৃক দাখিলকৃত ডাক্তারের দস্তখত এর ভিন্নতা দেখা যায়। ২টি ফরওয়ার্ডপত্রের মধ্যে ১টিতে তত্ত্বধায়ক জেলা সদর হাসপাতালের স্মারক নং-৫৮৭ (ওভার রাইটং) তাং-৪/৮/২০১৫ইং মুলে জখমি সনদ পাঠানো হয়। এর জখমী সনদপত্রে ডাঃ আবদুচ ছালাম গত ৮/৮/২০১৫ইং স্বাক্ষর করেন।

তদন্ত বোর্ড সদস্য জেলা সদর হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ মোঃ আয়ুব আলী বলেন, ডাঃ আবদু সালাম কর্তৃক ভিকটিম আমান উল্লাহকে দেয়া জখমী সনদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্রের নির্দেশিত আদেশ অনুযায়ী প্রদান করা হয় বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া সনদ প্রদানকারী হিসেবে স্বাক্ষর করা ডাঃ নোবেল কুমার বড়–য়ার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে বলে প্রমাণ মিলে। সনদের স্বাক্ষর মিল করতে ডাঃ নোবেলের ৫টি স্বাক্ষর নেয়া হয়। কিন্তু একটিরও মিলেনি। এবং সনদের স্বাক্ষর ডাঃ নোবেলের নয় বলে নিজেই স্বীকার করেন। এমনকি ডাঃ আবদুচ ছালাম স্বাক্ষরিত মেডিকেল বোর্ড কর্তৃক জখমী সনদপত্রে উল্লেখিত আঘাতের সাথে জরুরী বিভাগের রেজিষ্টার খাতায় লিপিবদ্ধ আঘাতের সাথে গড়মিল পায় তদন্ত বোর্ড।

তত্ত্বাবধায়ক কার্যালয় হতে স্মারক নং- সুপার/ কক্স/হাসপাতাল/গোঃ-২০১৫/৫৮৭ ( ওভার রাইটং) তাং-৪/৮/২০১৫ ইং মুলে ডাঃ আবদুছ ছালাম স্বাক্ষরিত মেডিকেল বোর্ড কর্তৃক জখমী সনদপত্র ফরওয়াডিং এ পাঠানো ছিঠিতে তত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষরটি ( ডাঃ রতন কুমার) তার নয় বলে তদন্ত বোর্ডকে অবহিত করেন। তত্ত্বাবধায়ক কার্যালয় হতে স্মারক নং- সুপার/ কক্স/হাসপাতাল/গোঃ-২০১৫/৫৮৭ মুলে টেকনাফ থানায় প্রেরিত জখমী সনদপত্র ফরওয়েডিং এ ৪/৮/১৫ তারিখ উল্লেখ আছে। কিন্তু ডাঃ আবদুচ ছালাম কর্তৃক জখমী সনদপত্রে ৮/৮/১৫ তারিখ উল্লেখ রয়েছে।

তদন্ত বোর্ড সভাপতি ডাঃ পুচনু ( সহকারী পরিচালক) বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্য অনুসন্ধান করা। দীর্ঘ সময় ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।’

আদালতে দাখিলকৃত তিন পৃষ্টার তদন্ত প্রতিবেদনে ডাঃ আবদুচ ছালামের জখমী সনদপত্র প্রদান বিধিবর্হিভুত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সহ তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে ।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালে কর্মরতদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ডাঃ নোবেল কুমার বড়–য়ার স্বাক্ষর জাল করা হলেও তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে জালজালিয়াতির কথা উল্লেখ করেনি। ডাঃ আবদুচ ছালাম প্রায় প্রতিদিন মোটা টাকার বিনিময়ে লোকজনকে গুরুতর জখমী সনদ সরবরাহ করেছেন। সিম্পল আঘাতের স্থানে গুরুতর জখম লিখে, উধবতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরবরাহ করা সনদ ফরমেট জালিয়াতি করে নিজের ইচ্ছে মতো ফরমেট তৈরি করে বিধি বর্হিভুত শত শত জখমী সনদ দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৯৫ সালে ১০ অক্টোবর জারিকৃত পরিপত্রে উল্লেখ রয়েছে যে কোন সরকারী হাসপাতাল থেকে জখমী সনদ ইস্যর ক্ষেত্রে একটি জখমী বোর্ড গঠনের নিয়ম রয়েছে। ওই সরকারী হাসপাতালের আরএমও ক্ষমতা বলে সভাপতি হিসেবে স্বাক্ষর করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তা ডাঃ আবদুচ ছালাম কিছুতেই মানেননি। প্রত্যেকটি জখমী সনদে জাল জালিয়াতি ও মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। একেকটি জখমী সনদের জন্য ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছে।

এমনকি জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ রতন চৌধুরী এসব সনদ বিধিবর্হিভুত দেখার পরেও প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা নিয়ে তিনি এসব ভুয়া জখমী সনদে রহস্য জনক কারণে ডেসপার করেন। এসব ভুয়ঁআ সনদের কারণে শতশত নিরীহ লোক মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে জেলা হাজতে রয়েছে। এই আবদুচ ছালাম জাল জালিয়াতি ছাড়াও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের আদেশ, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের আদেশ বরাবরই লঙ্ঘন করে আসছে।

সুত্রটি আরো জানান, থানা বা আদালত কর্তৃক চাহিদাপত্র অনুযায়ী সরবরাহকৃত তত্ত্বাবধায়কের কাছে রক্ষিত ডেসপার রেজিষ্টার ও হাসপাতালে এমসির নথি বা ফটোকপি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিংবা যে কোন সংস্থা তদন্ত করলে শতশত ভুয়া জখমী সনদের প্রমাণ মিলবে বলে একটি সুত্র নিশ্চিত করেছেন।

এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ মার্চ জেলা সদর হাসপাতালের এর্মাজেন্সি মেডিকেল অফিসার ডাঃ আবদুচ ছালামকে মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার হিসেবে বদলি করা হয়।

চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডাঃ আলা উদ্দিন মজুমদার স্বাক্ষরিত ( স্মারক নং-৪৬৮৬) মুলে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে ৩দিনের মধ্যে দায়িত্বভার হস্তান্তর ও বদলিকৃত স্থানে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। ৪দিন হতে সরাসরি অব্যাহতি প্রাপ্ত বলে গণ্য হবে তা উল্লেখ করা হয় পরিপত্রে। কিন্তু তিনি গত ২৪ মার্চ পর্যন্ত নতুন কর্মস্থল মহেশখালীতে যোগদান না করে বদলি ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন এবং জেলা সদর হাসপাতালে ঘুরাঘুরি করছে।

এব্যাপারে জানতে মুঠোফোনে কয়েক দফা ডাঃ আবদুচ ছালামের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি মুঠোফোন রিসিভ করেননি। অন্য কোনভাবে তার বক্তব্য নেওয়াও সম্ভব হয়নি।

পাঠকের মতামত: