ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে করোনা রোগিদের চিকিৎসা নিয়ে অসন্তোষ

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে করোনা রোগিদের চিকিৎসা নিয়ে অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে।

আইসিইউ সমস্যা, অক্সিজেন স্বল্পতা, ডাক্তার সংকট, নার্স-স্টাফদের আচরণসহ নানা কারণে হাসপাতাল নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে।

সপ্তাহ ধরে আইসোলেশন থাকার পরও সেখানে কোনো চিকিৎসা সেবা নেই বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।

তাছাড়া, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ল্যাব থেকে করোনা রিপোর্ট সরবরাহে বিলম্বের কারণে আক্রান্তরা সঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না।

স্যাম্পল জমা দিয়ে রিপোর্ট আসার আগেই মারা গেছে করোনা আক্রান্ত কয়েকজন ব্যক্তি। -অভিযোগ রোগী ও স্বজনদের।

করোনার উপসর্গ নিযে গত ৩ দিন ধরে সদর হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ডে অাছেন কক্সবাজার পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের দুনিয়ারছড়ার বাসিন্দা আনোয়ার করিম।

স্যাম্পল জমা দিয়েছেন, এখনো রিপোর্ট আসেনি। তার চোখের সামনে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে সোমবার সকালে মারা গেল মোহাম্মদ করিম নামের তার এলাকার এক তরুণ ব্যবসায়ী। এরপর থেকে টেনশন রয়েছেন আনোয়ার করিম।

সোমবার (১ জুন) সকাল ১১ টার দিকে মুঠোফোনে তিনি অভিযোগ করে বলেন, আইসোলেশনে আছি তিনদিন। এ পর্যন্ত কোন ওষুধ দেয়া হয়নি। স্যাম্পল জমা দিযেছি। এখনো রিপোর্ট পাইনি। আমার সামনে মোহাম্মদ করিম মারা গেল। তার রিপোর্ট এখনো আসে নি। মৃত্যুর পরে রিপোর্ট কার জন্য?

তিনি বলেন, আইসোলেশন ওয়ার্ডের ৯ নং সিটে আব্দুল হাকিম ও ১০ নং সিটি হাসান হাসান আলী নামের দুইজন রোগী এক সপ্তাহ পার হয়েছে। তারা এখনো রিপোর্ট পান নি। কোন চিকিৎসাও নেই। চিকিৎসাসেবা ছাড়া খালি খালি ভর্তি রেখে লাভ কি?

কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক তোফায়েল আহমদ নিজের ফেসবুকে লিখেছেন- কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের বেসিন ঠিক করার মত টাকারও কি অভাব ?

পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ খোরশেদ আলম লিখেন -সদর হাসপাতালের আইসিইউ বন্ধ। অক্সিজেন সল্পতায় মৃত্যু। মানুষ এত অসহায় হয়ে নিজের মৃত্য দেখেনি।

জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল হক সোহেল ৩১ মে ফেসবুক স্ট্যাটাসে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন -কক্সবাজার সদর হাসপাতালের এই অব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব কে নিবে?

তিনি লিখেন -বৈশ্বিক এই ক্রান্তিকালে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও মহা দূর্যোগের মুখোমুখি। দেশের এই ক্রান্তিকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন তাঁর সর্ব্বোচ্চ ত্যাগ, নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা এবং সুনিপুণ নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের জনগণকে এই মহাদূর্যোগ থেকে রক্ষা করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তখন আমাদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে দেখতে পাই ঠিক তার উল্টো চিত্র। এ যেন সুকৌশলে সরকারের সকল অর্জনকে এক নিমেষে ধুলোয় মিলিয়ে দেওয়ার জন্য এক গভীর ষড়যন্ত্র।

পর্যটন নগরী কক্সবাজার এখন কোভিট-১৯ এর রেড জোনে অবস্থান করছে। কিন্তু তার বিপরীতে কক্সবাজার এর মানুষ পাচ্ছেন না পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা। রোগীর তুলনায় হাসপাতালের সেবার মান ভয়াবহ অপ্রতুল। মানুষকে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।

আজ সকালে কক্সবাজার জেলা যুবলীগ নেতা আনোয়ার করিম করোনা উপসর্গ নিয়ে সদর হাসপাতালে কোভিট-১৯ টেস্ট দেওয়ার জন্য সদর হাসপাতালে যায়। কিন্তু সেখানে তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর আনোয়ার যখন তার নমুনা সংগ্রহের জন্য দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেন, তখন তার নমুনা নেয়া হবেনা বলে একজন নার্স তার সাথে অশালীন ব্যবহার করে। পরে আনোয়ার বিভিন্ন তদবির এর মাধ্যমে তার নমুনা দিতে সক্ষম হয়। তাকে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি দেওয়া হয়। কিন্তু ভর্তি দেওয়ার পর রাত ১২ টা পর্যন্ত তার কাছে কোন চিকিৎসক তো দূরের কথা কোন নার্স স্টাপও আসেনি। করোনা উপসর্গ ছাড়াও আনোয়ার একজন হাই প্রেশারের রোগী। সে নিজেই বুঝতে পারছে না আসলে সে কি করবে?

শহিদুল হক সোহেল লিখেন, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আইসোলেশনে ইউনিটের হাল ধরে আছে তরুণ ও জুনিয়র ডাক্তাররাই। সিনিয়র কোন ডাক্তারদের কেউ আইসোলেশন ইউনিটে যান না। বেশীর ভাগ সিনিয়র ডাক্তার নানান অজুহাতে নিজেদেরকে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে গেছেন। যার কারণে সদর হাসপাতালের করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীরা বলতে গেলে কোন চিকিৎসাই পাচ্ছেন না।

আজকের আরেকটি করুণ ও অমানবিক অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। তাহলে বুঝতে পারবেন সদর হাসপাতালে আসলে কি হচ্ছে- কক্সবাজারের নুনিয়াছড়া মোহাম্মদ করিম নামে এক ব্যক্তি করোনা উপসর্গ নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়। আজ রাতে তাঁর শ্বাস কষ্ট বেড়ে গেলে তাকে আইসিইউতে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে তাকে আইসিইউতে নেওয়া তাগিদ দিলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় সদর হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য কোন আইসিইউ’র ব্যবস্থা নাই! তারপর সে নিদেনপক্ষে তাকে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বললে, কর্তৃপক্ষ জানায় হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা নাই। পরে তার পরিবার বাইরে থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন এনে তাঁকে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই হচ্ছে আমাদের সদর হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার মান।

এছাড়া আরো অনেক অব্যবস্থপনা আছে যেগুলির কারণে কক্সবাজার এর মানুষ আজ আতংকিত। যেমন একজন করোনা সন্দেহ রোগীর টেস্টের রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৮-১০ পর, যা সমাজের জন্য ভয়ংকর একটা বিষয়।

জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল হক সোহেল তার স্ট্যাটাসে আরো লিখেন, চিকিৎসা পেশা অন্য পেশাগুলোর মতো নয়। এটি একটি মহান পেশা। এই পেশায় মানব সেবাটাই প্রধান ব্রত। কিন্তু স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বলে যদি আপনারা রোগীর সেবা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তাহলে আমি বলবো আপনাদের এই মহান পেশায় আসাটাই উচিত হয়নি। আপনাদের কারণে সরকারের এত এত অর্জনগুলি যদি ম্লান হয়ে যায় তাহলে সে দায়ভার কে নিবে?

এই অব্যবস্থাপনাগুলি কি অনিচ্ছাকৃত বা সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে নাকি সরকারকে বিব্রত করার কোন সুনিপুণ গভীর ষড়যন্ত্র?

এ প্রসঙ্গে সদর হাসপাতালের সুপার ডা: মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে বলেন, যেগুলো আমাদের দায়িত্ব নয়, সেগুলো আমাদের চাপিয়ে দিলে সমস্যা তো হবেই। ২০০ জন রোগির দুইটা করে হলে ৪০০ স্যাম্পল নিতে হয়। ১ জন লোকের পক্ষে কিভাবে তা সম্ভব? এগুলোর জন্য তো সদর টিএইচওর মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কথা।

তিনি বলেন, আমরা স্যাম্পল নেব শুধু যারা সদর হাসপাতালের রোগি এবং যারা টিকিট নিয়ে আসবে- তাদের। এখন সব রোগির স্যাম্পল নিতে হচ্ছে। আমাদের মাত্র ২ জন টেকনিশিয়ান রয়েছে। সেখানে একজন থাকে কোয়ারেন্টাইনে। আরেকজন স্যাম্পল কালেকশন করেন। হাসপাতালের রোগি ছাড়াও বাইরের রোগিদের চাপ বেশী। একজন টেকনিশিয়ান কত পারে?

তিনি বলেন, আইসোলেশন বেডে চিকিৎসার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, চিকিৎসা না পেলে এত রোগি কিভাবে রিলিজ হচ্ছে?

১০ বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে এ পর্যন্ত ১০১ জন রিলিজ হয়েছে। সবাইকে সাধ্যমতো চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়েছে। ডাক্তাররা সারাক্ষণ ফলোআপ করছেন। চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ আমাদের বোধগম্য নয়।

তবে, ভেন্টিলেটর সমস্যার কারণে করোনা রোগিদের কাঙ্খিত চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সুপার।

সোমবার সকালে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া শহরের মধ্যম নুনিয়ারছড়ার রোগি মোহাম্মদ করিমের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপার ডা: মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, প্রথম দিক থেকেই তার অবস্থা খুব সংকটাপন্ন ছিল। সদরে ভেন্টিলেটর না থাকায় তাকে চট্টগ্রাম রেফার করা হয়েছিল। স্বজনেরা নিজ দায়িত্বে এখানে রেখে দেয়। হাসপাতালের অক্সিজেন এ্যাম্বুলেন্সটিও অকেজো বলে জানিয়েছেন ডা: মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।সিবিএন

পাঠকের মতামত: