ডেস্ক নিউজ :: টেকনাফের মৌলভীপাড়ার মো. আনোয়ার হোসেনের পুত্র জাবেদ মোস্তফা। এবি ব্যাংকের টেকনাফ শাখায় তার নামে রয়েছে তিনটি অ্যাকাউন্ট। এসব অ্যাকাউন্ট খোলার সময় তার পেশা উল্লেখ করা হয় ‘মুদি দোকানি’ হিসেবে। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, এই মুদি দোকানির সেই তিন অ্যাকাউন্টে পাঁচ বছরে লেনদেন হয়েছে ৩১ কোটি টাকা। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনলাইনে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ এই মুদি দোকানির তিনটি হিসাবে জমা হওয়ার পর তিনি তা উত্তোলন করেছেন।
বিষয়টি বিস্ময়কর ঠেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এসব লেনদেনের বিষয়টি দেখছে ‘সন্দেহজনক লেনদেন’ হিসেবে। এ ব্যাপারে সিআইডিতে পাঠানো এক প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখ করেছে, জাবেদ মোস্তফার হিসাবগুলোয় সংঘটিত লেনদেন তার ব্যবসার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাগরপথে মানবপাচারে জড়িত কক্সবাজারের ১০৯ জন গডফাদার ও ৩৫৮ জন সক্রিয় মানবপাচারকারীর একটি তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায় তাদের ব্যাংক হিসাব তলব করার জন্য। ওই তালিকায় মানবপাচারের গডফাদার হিসাবে জাবেদ মোস্তফার নামও রয়েছে। আর এই জাবেদ মোস্তফারই আপন ভাই তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক মোহাম্মদ আছেম। আছেম গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর কারওয়ানবাজার থেকে মানবপাচারের অভিযোগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেপ্তার হন। একই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে।
মামলায় আছিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, তিনি মালয়েশিয়ায় মানবপাচার করেন। শুধু তাই নয়, পাচারকৃতদের সেদেশে আটকে রেখে বাংলাদেশে তাদের স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণও আদায় করেন। আছেমের কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও মিলেছে ৯ কোটি টাকা লেনদেন হওয়ার তথ্য। জাবেদ মোস্তফার মতো আছেমের টাকাও জমা হয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। তার হিসাবে জমাকৃত অর্থের সিংহভাগই মুক্তিপণের মাধ্যমে অর্জিত, এমন তথ্য প্রমাণই উঠে এসেছে সিআইডির তদন্তে। গ্রেপ্তারের পর তাকে কাঠগড়ায় তোলা হয়। কিন্তু একদিনের জন্যও কারাগারে যেতে হয়নি আছেমের। জামিনে বেরিয়ে গেছেন তিনি। আছেমকে রক্ষায় প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তি কলকাঠি নাড়ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
শুধু আছেম কিংবা তার ভাই জাবেদ মোস্তফার ব্যাংক হিসাবেই নয়, আছেমের মা খতিজা বেগমের অ্যাকাউন্টেও লেনদেন হয়েছে প্রায় দেড়কোটি টাকার। এছাড়া আছেমের সহযোগীদের অ্যাকাউন্টেও কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট।
সিআইডিতে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১ সালের ১৫ মার্চ এবি ব্যাংকের টেকনাফ শাখায় জাবেদ মোস্তফার নামে একটি চলতি হিসাব খোলা হয় (হিসাব নম্বর-৪১২৮-৩৫৯৭৪০-০০০)। এই হিসাব খোলার দিন থেকে ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জমা হয়। এ সময়ের মধ্যে সমপরিমাণ অর্থ উত্তোলনও করা হয়। হিসাবটির অধিকাংশ অর্থই জমা হয়েছে চেক নতুবা অনলাইনে অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে। ২০১৫ সালের ৫ মার্চ জাবেদ মোস্তফার এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই হিসাবটি বন্ধ রাখা হয়।
এবি ব্যাংক টেকনাফের ওই শাখাতেই জাবেদ মোস্তফা কর্তৃক পরিচালিত ‘মেসার্স সাগর পাড় ফিশিং’ নামে একটি চলতি হিসাব (হিসাব নম্বর- ৪১২৮-৭৯৫০৪১-০০০) খোলা হয় ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা জমা হয় এই হিসাব নম্বরে। এ সময়ের মধ্যে সমপরিমাণ টাকা উত্তোলনও করা হয়। বর্তমানে এই হিসাবে ৬০ হাজার ৩৮২ টাকা জমা রয়েছে। সব মিলিয়ে জাবেদ মোস্তফার ৩টি ব্যাংক হিসাবে মোট ৩১ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো মানবপাচারকারীদের তালিকা ধরে ব্যাংক হিসাব তলব করে জাবেদ মোস্তফার ওই লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। সে মাদক পাচারেও জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করতে সিআইডিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে, জানান ওই কর্মকর্তা।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমরা আছেম ও তার ভাইয়ের ব্যাংক হিসাবে যেসব লেনদেনের তথ্য পেয়েছি, সেসবের বিষয়ে তদন্ত চলছে। আমাদের কাছে একাধিক ভিকটিমের স্বজন অভিযোগ করেছেন, বিদেশে লোক পাঠিয়ে সেখানে আটকে রেখে দেশে থাকা তাদের স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে। আমরা এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আছেম ও জাবেদ মোস্তফার নেতৃত্বাধীন সংঘবদ্ধ একটি চক্র মানবপাচারের জন্য প্রথমে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দালাল নিয়োগ করে। দালালরা লোক ঠিক করে নিয়ে আসে। এরপর ভিকটিমের কাছ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার খরচ নিয়ে টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হয়। টেকনাফ থেকে ট্রলারে করে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে রাখা হয়। সেখানে পাচার করা লোকদের আটকে রাখে চক্রের সদস্যরা। এরপর নির্যাতন করে তাদের বাংলাদেশে অবস্থানরত স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয় এবং আদায় করা হয়। যারা মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হন, তাদের থাইল্যান্ডের জঙ্গলে হত্যা করা হয়। চক্রটি মুক্তিপণের টাকা নেয় নগদে অথবা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফের বিভিন্ন ব্যাংকে এ চক্রের সদস্যদের অ্যাকাউন্ট রয়েছে মুক্তিপণের টাকা জমার জন্য। আমাদের সময়
পাঠকের মতামত: