ডেইলি স্টার :: কক্সবাজারে আমলা, রাজনীতিবিদ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যদের নিয়ে তৈরি একটি সিন্ডিকেট সুপরিকল্পিতভাবে তিনটি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
দুটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী বিকল্প থাকা স্বত্তেও বেশি দাম দিয়ে জমি কেনা হয়েছে, ফলে সরকারের অতিরিক্ত ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আরেকটি প্রকল্পে ভূমি অধিযাচনের (রিকুইজিশন) অজুহাতে আরও ৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম অফিসের তদন্তে সরকারি টাকায় এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বিত্তবান হওয়ার বিস্ময়কর কাহিনী উঠে এসেছে।
তিনটি প্রকল্পের জন্য দুদক তিনটি পৃথক মামলা করেছে। তদন্তকারী কর্মকর্তার ৭৫০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ২৩ জন অ্যাডমিন ক্যাডারের কর্মকর্তা সহ মোট ৪৪ জন সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন কক্সবাজারের সাবেক উপকমিশনার, সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার, সাবেক ইউএনও, পিবিআই’র কক্সবাজার ইউনিটের বর্তমান পুলিশ সুপার ও সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ চার সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। এছাড়াও তাদের সঙ্গে আছেন ২৩ জন জরিপকারী, সাত জন কানুনগো, ছয় জন অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ও দুই জন সাব-রেজিস্ট্রার।
এছাড়াও তালিকায় সাতজন রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে। যাদের মধ্যে আছেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
দুদকের প্রতিবেদনটি গত ৩০ জুন জমা দেওয়া হয়েছে। সাধারণত এ ধরনের প্রতিবেদনগুলো কর্মকর্তারা উপ-পরিচালকের কাছে জমা দেন এবং তিনি পরবর্তীতে তা দুদকের মহাপরিচালকের (তদন্ত) কাছে পাঠান। এরপর প্রতিবেদনটিকে দুদকের চেয়ারম্যানের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। অনুমোদনের পর প্রতিবেদনটি চার্জশিটের অংশ হিসেবে আদালতে জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
তবে গতকাল পর্যন্ত প্রতিবেদনটি চট্টগ্রাম দুদক অফিসের উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলমের কাছে আটকে আছে। কয়েকদিন আগে প্রতিবেদনের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মাহবুবুল বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদনটি যাচাই করছি। এটি বেশ বড় হওয়ায় আমাদের আরও সময় লাগবে।’
প্রতারণার দীর্ঘ উপাখ্যান
সরকার উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে ৭৩টি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মোট মূল্যমান তিন দশমিক পাঁচ লাখ কোটি টাকা। প্রকল্পের প্রয়োজনের সরকার ২৫ হাজার কোটি টাকার ভূমি অধিগ্রহণেরও পরিকল্পনা করেছে।
তদন্তে দুদক তিনটি প্রকল্পের শুরু থেকেই দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। প্রকল্পগুলো হচ্ছে পিবিআই’র প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, কক্সবাজার পৌরসভার পানি পরিশোধনাগার প্রকল্প ও ইস্টার্ন রিফাইনারি’র সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণ প্রকল্প।
পিবিআই’র কার্যালয় ও পানি পরিশোধনাগারের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কমিটি (ডিএলএসি) আইনি বাঁধা থাকা স্বত্তেও মালিকানা নিয়ে বিতর্ক আছে এরকম জমি নির্বাচন করে।
ডিএলএসি গত বছর পিবিআই ভবনের জন্য কলাতলিতে ২৯ দশমিক ২৯ কোটি টাকায় ১০০ শতাংশ জমি এবং পানি পরিশোধনাগারের জন্য ৩৬ কোটি টাকায় দুই একর জমি অধিগ্রহণ করে। তদন্তকারী কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, সঠিক প্রক্রিয়ায় অধিগ্রহণ করলে জমির খরচ হত ১৭ কোটি টাকার চেয়ে কিছু বেশি।
এক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণ ও অধিযাচন নীতিমালার লঙ্ঘন করা হয়েছে। নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ভূমি অধিগ্রহণকারী সংস্থা এবং ডিএলএসি’র প্রতিনিধিদের সম্মিলিতভাবে সাশ্রয়ী ও বিকল্প ভূমি খুঁজতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে অন্য কোন সরকারী সংস্থার অধিগ্রহণ করা ভূমিকে আবারও অধিগ্রহণ করা না হয়।
পরবর্তীতে জানা যায়, বহু বছর আগে আরেকটি সরকারি সংস্থা ঐ ভূমির অংশবিশেষ অধিগ্রহণ করেছে। দুদকের তদন্তে জানা গেছে, ভূমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। জানা গেছে, পিবিআই ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৫ জন ভুয়া মালিক প্রায় ২৯ কোটিরও বেশি টাকা পেয়েছেন।
দ্য ডেইলি স্টারের সংগ্রহ করা কিছু নথি অনুযায়ী, কক্সবাজার পৌরসভার মেয়রের পরিবারের সদস্যরা পানি পরিশোধনাগার প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির ভুয়া মালিক সেজে ৩৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন ও সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার টাকার লেনদেনের বিষয়টি দেখভাল করেন। বর্তমানে কামাল স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং আফসার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন।
এই অসাধু প্রক্রিয়ার কারণে কয়েক হাজার ভূমি মালিক তাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তারা এই বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন ও ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ে অভিযোগ জমা দিলেও সমস্যার সমাধান হয়নি।
নাজিম উদ্দিন জানান, তিনি নিয়ম অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণের কোন নোটিশ পাননি। যখন তিনি বিষয়টি জানতে পারেন, ততক্ষণে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
দুদক কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, পিবিআই’র ভবন নির্মাণ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা তিনজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা শুরু থেকেই জানতেন ডিএলএসি’র কাছে জমা দেওয়া ভূমি সংক্রান্ত নথিগুলো ভুয়া ছিল।
এই কর্মকর্তারা হলেন কক্সবাজার পিবিআই’র সাবেক পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান ও আবদুল্লাহ আল মামুন। এই সংবাদদাতার সংগ্রহ করা কিছু নথি অনুযায়ী, ডিএলএসি ভুয়া নথির অনুমোদন দেওয়ায় ভুয়া মালিকরা টাকা পান।
ভূমি রিকুইজিশনে দুর্নীতি
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্প থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভূমি কর্মকর্তারা ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কালামারছড়া ইউনিয়নে রিকুইজিশন নেওয়া ১৯১ একর খাস জমিতে ডিপো তৈরি করার জন্য একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়।
কালামারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরীফ এবং কুতুবজোম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন খোকন প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে একটি ‘সমঝোতা’ করেন। দুই চেয়ারম্যান প্রকল্পের জমি থেকে বাড়িঘর এবং অন্যান্য অবকাঠামো সরানোর জন্য তাদের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকা নেন।
দুদক কর্মকর্তা জানান, তারা জোরপূর্বক বাড়িঘর ভেঙ্গে দেন এবং গরীব ও অসহায় বাসিন্দাদের উৎখাত করেন। নিয়ম অনুযায়ী এই কাজটি স্থানীয় জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব।
সহজে স্থানান্তর করা যায় না এরকম কোনো সম্পত্তি সরকারি কাজ বা জনগণের স্বার্থ রক্ষার প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন হলে আইন অনুযায়ী স্থানীয় জেলা প্রশাসন সেটিকে রিকুইজিশন দিতে পারে। রিকুইজিশনের ক্ষেত্রে প্রকৃত মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
কিন্তু সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় তারেক ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য এই টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কৃষকরা চাষাবাদ করতেন এমন ১৪৪ একর জমির ওপর চীনা প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যালয় নির্মাণ করেছে।
ভূমি কর্মকর্তারা প্রকৃত কৃষকদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ থেকে তাদের বঞ্চিত করেন। তারেক ও মোশাররফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা অভিযোগ অস্বীকার করেন।
গ্রেপ্তারকৃতরা সব তথ্য ফাঁস করেন
২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মোঃ ওয়াসিম নামের এক জরিপকারীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। দুই দিন পর দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে।
একই মাসে দুদক আরও তিন জন মধ্যস্থতাকারীকে গ্রেপ্তার করে। সালা উদ্দিন, কামরুদ্দীন ও সেলিম উল্লাহ ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের কমিশন দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
তারা বিভিন্ন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, জরিপকারী ও কানুনগোদের মোট এক কোটি এক লাখ ২৩ হাজার টাকা ঘুষ দেওয়ার কথাও স্বীকার করেন।
তাদের ফ্ল্যাট থেকে র্যাব প্রায় ১১ বস্তা নথি জব্দ করে। সেগুলোর মধ্যে ছিল ক্ষতিপূরণের আবেদনপত্র, চেক এবং অন্যান্য নথি। যেগুলো অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কার্যালয়ে থাকার কথা।
তাদের ডায়েরিতে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া কমিশনের বিস্তারিত উল্লেখ করা ছিল। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও জব্দ করা নথি বিশ্লেষণে করে দুদক তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতির বিস্তারিত তথ্য জানতে পারে।
আরেক গ্রেপ্তারকৃত সিন্ডিকেট নেতা সিআইপি (কমার্শিয়ালি ইম্পরট্যান্ট পার্সন) মোহাম্মদ ইদ্রিস এক পিবিআই পরিদর্শককে ৪০ লাখ টাকা দেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করেন। দুদকের সূত্র অনুযায়ী, সেই পরিদর্শক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামানের কাছে টাকাটি পৌঁছে দেয়।
কেউ কোন অপরাধ করেনি!
পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন তিনি কাগজপত্রে কিছু অসংগতি খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি দাবী করেন, ‘আমি জেলা প্রশাসনের কাছে চিঠি দিয়ে তাদেরকে এই অসঙ্গতি দূর করতে বলি। ফলে সড়ক ও জনপথ বিভাগ ও জেলা প্রশাসন একটি ডিজিটাল সমীক্ষা পরিচালনা করে ভুলগুলো দূর করে।’ তবে, দুদক পিবিআই প্রকল্পের সব ভূমি সংক্রান্ত নথি বিশ্লেষণের সময় এ ধরনের কোন চিঠি পায়নি।
সারোয়ার দাবী করেন, তিনি নিজ হাতে চিঠিটি পাঠিয়েছেন। তিনি আরও দাবী করেন, তিনি তদন্ত কর্মকর্তাকে অন্যান্য ভূমি সংক্রান্ত নথির সঙ্গে চিঠির অনুলিপিও দিয়েছেন। তবে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা জানান তিনি এ ধরনের কোন নথি পাননি।
কক্সবাজার পিবিআই’র সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামানের সঙ্গে ফোন ও মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোন উত্তর দেননি। একই ইউনিটের আরেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়নি।
বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগে উপ-সচিব হিসেবে কর্মরত কামাল হোসেন দুদকের প্রতিবেদনটিকে নাকচ করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমি এসব অভিযোগের বিষয়ে কিছু জানি না। আমি সব কিছু আইন অনুযায়ী করেছি।’
সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আফসার জানান, যে সংস্থার জমি প্রয়োজন ছিল, তারাই এর নির্বাচন করেছে। তিনি দাবী করেন, সংস্থাটি তাদের ‘কৌশলগত চাহিদা’ অনুযায়ী ভূমি নির্বাচন করেছে।
তিনি এই সংবাদদাতাকে একটি এসএমএস এর মাধ্যমে জানান, ‘পিবিআই প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সব আইন সম্পূর্ণরূপে মেনে চলা হয়েছে।’
কক্সবাজার সদর উপজেলা’র সাবেক ইউএনও মাহফুজুর রহমান বর্তমানে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত আছেন। ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি অনেকদিন আগে হয়েছে বলে তিনি এটি ভুলে যাওয়ার দাবি করেন।
ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা শামীম হোসেন পিবিআই প্রকল্পের ভুয়া মালিকদের জন্য ক্ষতিপূরণের চেকগুলো রিলিজ করেন। তিনিও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
পাঠকের মতামত: