ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

উখিয়া-টেকনাফে হাইওয়ে পুলিশের ঘুষ বাণিজ্য, রোহিঙ্গাসহ চালকদের হাতে হাতে টোকেন

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ উখিয়া-টেকনাফ আঞ্চলিক সড়কে রাস্তার পাশে একদিকে রোহিঙ্গা বাজার অপরদিকে রোহিঙ্গাদের মালিকানাধীন শতশত ইজিবাইক (টমটম)। এ যেন স্থানীয়দের জন্য সড়কে যাতায়াতে বিষফোঁড়া। হাইওয়ে পুলিশ এসব দেখেও দেখে না।

জানা যায়, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে নগদ টাকা কামাই করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। উখিয়া টেকনাফে আশ্রিত হাজারো রোহিঙ্গা এক বা একাধিক টমটম ও সিএনজি টেক্সীর মালিক। চালকও রোহিঙ্গা যুবক-কিশোর। একারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। আইন-কানুনের তোয়াক্কা করছে না টমটম-ইজিবাইকের অদক্ষ এই রোহিঙ্গা চালকরা। এইসব চালকের নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স, নেই কোন গাড়ির লাইসেন্স। নেই কোন ধরণের প্রশিক্ষণও। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প এলাকার বাইরে আসার অনুমতি না থাকলেও রোহিঙ্গা চালকরা সিএনজি ও টমটম নিয়ে বাঁধাহীনভাবে সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

স্থানীয়রা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে এসে দিব্যি গাড়ি চালালেও রোহিঙ্গাদের এ বিষয়ে নজরে পড়েনা হাইওয়ে পুলিশের। জবাবদিহিতার বাইরে গিয়ে দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করে সময় পার করছে তারা। বর্তমানে এই সড়কে অনিয়ম যেন নিয়মেই পরিণত হয়েছে। দায়িত্ববান পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে সড়কে অবৈধ কাজগুগুলো বৈধতা পাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

সূত্র জানায়, মাসিক টোকেনের টাকা না দিলে রাস্তায় নেমে পড়ে হাইওয়ে পুলিশের কতিপয় অসৎ সদস্য। তারা ব্যাটারিচালিত টমটম ও সিএনজি আটক করে ঘুষ বাণিজ্যে মেতে উঠে। মোটরবাইক ও পিকআপ ভ্যান থেকেও তারা টোকেন বাণজ্য করে থাকে। নির্ধারিত টাকা পাবার পর চালকদের হাতে তুলে দেয়া হয় একেকটি টোকেন। আর এ টোকেন নিয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে টমটম, ইজিবাইক, সিএনজি ও ডাম্পার। একই জায়গায় ৩ বছর বা তার অধিক সময় চাকরির কারণেই মাসোয়ারা আদায়ে বেপরোয়া তুলাবাগান, উত্তর কুতুপালং ও বালুখালীর হাইওয়ে পুলিশ। চালক ও মালিকরা জিম্মি হয়ে পড়েছে চিহ্নিত কিছু দালালের কাছে। মাসিক চুক্তিতে শুধু হোয়াইক্যংয়ে দুই শতাধিক অটোরিকশার রয়েছে মহাসড়কে।

টাকা উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছে সেক্টর ভিত্তিক অর্ধডজনেরও অধিক লোক। আটকে রাখা টমটম ছাড়ের ফি কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। ক্ষেত্র বিশেষ ১২-১৫ হাজার টাকা। বিশেষ তদবির থাকলে ফি সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা।

পুলিশি হয়রানির ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১০-১৫ জন চালক ও মালিক বলেন, আর সহ্য করতে পারছি না। সিএনজি, টমটম আটকের পরই কতিপয় দালাল ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। দালালিতে রয়েছে গণমাধ্যমের কর্মী পরিচয়ের কয়েকজন অসাধু ব্যক্তি। এরপর আস্তে আস্তে টাকার চুক্তি করে। অনেক সময় দালাল ছাড়া স্যারের সঙ্গে কথাও বলা যায় না। কেউ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে মামলা দেয়ার হুমকি আসে। চালকদের ভাষায় মহিউদ্দিন নামের এক স্যারের ব্যবহার ও যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ।

হোয়াইক্যং-য়ে ট্রাক, টমটম, পিকআপ ভ্যানের হাদিয়ার টাকা উত্তোলনের দায়িত্বে রয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি। সরেজমিনে চালক-মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হোয়াইক্যং হাইওয়ে পুলিশ এখন ঘুষ বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠছে মহাসড়কে। বিধি না থাকলেও সড়কের পাশে রয়েছে একাধিক স্ট্যান্ড। এসব স্ট্যান্ড থেকে মাসিক মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা যাচ্ছে কিছু নাম সর্বস্ব শ্রমিক নেতা ও পুলিশের পকেটে। হোয়াইক্যং বিজিবি চেকপোস্টের পর থেকে দিনে রাতে তাদের টার্গেট সিএনজিচালিত অটো, ব্যাটারিচালিত টমটম ও মাল বোঝাই ট্রাক। হিসাব না মিললেই মামলা। আর মামলাগুলো হচ্ছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সামাল দেয়ার একটা অস্ত্র। আটকের পর দর কষাকষিতে জড়িয়ে পড়ে পুলিশের কিছু দালাল। তারা প্রথমে চালক বা মালিকের সঙ্গে ছাড়ের মূল্য নির্ধারণে কাজ শুরু করে। নিজের কমিশনসহ হিসাব মিললে গাড়ি ছাড়ের ব্যবস্থা করে তারা। হিসাব না মিললেই ঘুরাতে থাকে দিনের পর দিন। হোয়াইক্যং এর আশেপাশের বিভিন্ন স্ট্যান্ডের লোকজনের সঙ্গে রয়েছে দালাল ও পুলিশের গোপন মাসিক চুক্তি। ১৫-২০টি গাড়ির টাকা মাসে একবার জমা দেয় দালাল অথবা পুলিশের চিহ্নিত লোকের কাছে।

টেকনাফ সড়কে চলাচলকারী নিবন্ধনবিহীন গাড়ির সংখ্যা অনেক। তবে আটকের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। জনৈক শ্রমিক নেতা জানান, মাসোয়ারা এখন অনেক বেশি। হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করব নাকি চালক-শ্রমিকদের পেটের খবর রাখব- ভেবে পাইনা। এমতাবস্থায় এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন তিনি।

এদিকে, নতুন বছরের শুরু থেকেই এ পর্যন্ত কয়েকবার সড়কে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু হাইওয়ে পুলিশের তেমন কোন তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ করেছেন ওই সড়কে যাতায়াতকারি যাত্রী ও একাধিক চালক। ১৪ জানুয়ারি ভোররাতে হোয়াইক্যং ৩নং ওয়ার্ডের কুতুবদিয়া পাড়া সংলগ্ন সড়কে সিএনজি ও বৈদ্যুতিক তারের ব্যারিকেড দিয়ে এস,আলম ও ১টি সৌদিয়া নাইট কোচে ডাকাতি করে মুখোশধারী একদল ডাকাত। একপর্যায়ে মসজিদের মাইকে প্রচার করে মানুষ জড়ো হলে ডাকাত দল পালিয়ে যায়। কোনক্রমে ডাকাতের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সৌদিয়া নাইট কোচ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় নয়াপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে অবহিত করেন। এরপর হাইওয়ে পুলিশ নামমাত্র ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায়। কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, ঘটনাস্থলের অতি নিকটে ২টি পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও সেসময় পুলিশের কোন উপস্থিতি ছিলনা। শুধু তাই নয়, চলতি বছরের (জানুয়ারি) গত দুই সপ্তাহে টেকনাফ সড়কে বেশ কয়েকজন পর্যটক দম্পতির সর্বস্ব লুটে নিয়েছে ডাকাত দল।

নয়াপাড়া হাইওয়ে পুলিশের ইন্সপেক্টর মঞ্জুরুল হক আখন্দ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ডাকাতির খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। কিন্তু ওইসময় কাউকে পাওয়া যায়নি।

হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মুজিবুর রহমান চকরিয়া নিউজকে বলেন, এ বিষয়ে আমি অবগত নয়। তবে অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বলাবাহুল্য, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের বিভিন্ন স্পটে ডাকাতি প্রতিরোধসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য হোয়াইক্যং ও নয়াপাড়া হাইওয়ে এবং জেলা পুলিশের পৃথক পৃথক ২টি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। যাত্রী ও গাড়ি চালকদের অভিযোগ, পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা চিহ্নিত ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রাতে টহল না দিয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে গাড়ি তল্লাশির কাজে ব্যস্ত থাকে। ফলে পুলিশের অনুপস্থিতিতে তৎপর হয়ে উঠে ডাকাত দল।

 

পাঠকের মতামত: