আবদুল আজিজ, বাংলাট্রিবিউন :: সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকাণ্ডের পর কিছুদিন ইয়াবা পাচার কমে এলেও সম্প্রতি আবার তা ব্যাপক হারে বেড়েছে। আর এজন্য মাদক কারবারিরা নিত্যনতুন রুট পরিবর্তন করছে। সীমান্তের বিভিন্ন পাহাড়ি সড়ক ব্যবহার করে নিরাপদে পাচার করছে কোটি টাকার ইয়াবা। গত শনিবার (৯ জানুয়ারি) পুলিশের হাতে রামুর ঈদগড় সড়কে এক লাখ পিস ইয়াবাসহ এক সিএনজি চালককে গ্রেফতারের পর নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গত বছরের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ। এ ঘটনার পর কিছু দিন কমে আসে ইয়াবা পাচার। কক্সবাজার জেলা পুলিশে গণহারে বদলিসহ বিভিন্ন ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে ইয়াবা পাচারকারী সিন্ডিকেট রুট পরিবর্তন করে ইয়াবা পাচার করছে। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী সড়ক টেকনাফ হয়ে উখিয়ার বালুখালী ও বাইশফাঁড়ি সড়ক ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। একইভাবে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ সংলগ্ন শৈলরডেবা সড়ক হয়ে রত্নাপালং ভালুকিয়া, হলদিয়াপালং পাতাবাড়ি সড়ক দিয়ে প্রবেশ করছে নাইক্ষ্যংছড়ি সোনাইছড়ি হয়ে ঈদগড় সড়কে। এই সড়ক হয়ে ইয়াবার চালান যাচ্ছে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
শনিবার (৯ জানুয়ারি) সকাল পৌনে ১০টার দিকে ঈদগাঁও-ঈদগড় সড়কের ছেনুছড়া এলাকা থেকে এক লাখ পিস ইয়াবাসহ হাফেজ আহমদ (৩৫) নামের এক ইয়াবা কারবারিকে গ্রেফতার করে কক্সবাজার গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এ সময় পাচার কাজে ব্যবহৃত একটি সিএনজিও জব্দ করা হয়। সে বান্দরবানের রুমা উপজেলার রুমকি গ্রামের মৃত আব্দুল হাফেজের ছেলে। তবে তার বর্তমানে বসবাস কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁওয়ে এবং সে ওই সিএনজির চালক।
কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জানান, শনিবার ভোররাত থেকে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ঈদগাঁও-ঈদগড় সড়কের ছেনুছড়ায় চেকপোস্ট বসানো হয়। চলে সকালে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। তারপর ঈদগড় দিক আসা সিএনজিকে থামানো হয়। সেটি তল্লাশিকালে ইঞ্জিন বক্সের ভেতর থেকে ১ লাখ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। পরে সিএনজি চালক হাফেজ আহমেদ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইয়াবা পাচারের কথা স্বীকার করে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা সীমান্তের বিভিন্ন অলিগলি, ছোট সড়কগুলোকে নিরাপদ রুট হিসাবে বেছে নিয়েছে। এ কারণে এসব সড়ক চিহ্নিত করে পুলিশ অভিযান অব্যাহত থাকবে। এছাড়াও এক লাখ পাচারের পেছনে কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে সীমান্তের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছেন, পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা থাকা সত্ত্বেও উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের ৩৫টি পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসছে বাংলাদেশে। শুধু স্থলপথ নয়, আসছে সাগরপথেও। নিত্যনতুন কৌশলে মাদকের চোরাচালান আসছে। কখনও ত্রাণবাহী কিংবা জরুরি পণ্যবাহী যানে; মাছ ধরার ট্রলার, কাভার্ড ভ্যান, কখনও পায়ুপথে, কখনও যানবাহনের ইঞ্জিনের কাভারে করে গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে ইয়াবা। করোনার মধ্যে মাদকসেবীদের জন্য হোম ডেলিভারিও হচ্ছে। টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, দমদমিয়া, লেদা, রঙ্গিখালী, উলুচামারী, মৌলভীবাজার, নোয়াখালীয়াপাড়া, শাপলাপুর, সাতঘরিয়াপাড়া, উখিয়ার আমতলি, পালংখালী, মরিচ্যা, রেজুখাল, নাইক্ষ্যংছড়ির গর্জনবুনিয়া, তুমব্রুসহ অন্তত ৩৫টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে। রোহিঙ্গা শিবির-সংশ্লিষ্ট এলাকা দিয়ে ইয়াবা আসছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।
বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থানের পরও প্রতিদিন কোনও না কোনও পয়েন্ট থেকে ইয়াবাসহ পাচারকারী বা পরিত্যক্ত ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছেই। এভাবেই প্রতিনিয়ত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কৌশলে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা চালান নাফ নদী ও সমুদ্রপথে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। গত ৩১ জুলাইয়ের পর ইয়াবার চালান তুলনামূলক হারে কমে এলেও সম্প্রতি কিছুটা বেড়ে যায়। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে হঠাৎ করে বৃহৎ আকারের ইয়াবার চালান আটকের ঘটনায় আবারও নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অনেকেই জানিয়েছেন, উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবাসহ মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। যার ফলে এ পর্যন্ত বড় কোনও ইয়াবা কারবারি আটকের খবরও পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি আত্মসমর্পণকারী সীমান্তের ইয়াবা গডফাদারদের অনেকেই জামিনে বের হয়ে বহাল তবিয়তেই ইয়াবা কারবার চালাচ্ছে নতুন করে। ‘ইয়াবার গেটওয়ে’ হিসেবে পরিচিত টেকনাফের খুব কাছাকাছি মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে প্রায় ৪০টি ইয়াবা কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার চালান আসে একমাত্র টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সৌমেন মণ্ডল জানান, সীমান্তে যেকোনও মূল্যে ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদকের চোরাচালান বন্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার। ইয়াবা পাচারকারীদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবসময় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ইয়াবার চালান বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের। আমরা বসে নেই, প্রতিনিয়ত চলছে আমাদের মাদকবিরোধী অভিযান।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ৬০ জন গডফাদারসহ ১১৫১ জন মাদক কারবারির তালিকা প্রকাশ করে সরকার। এই তালিকায় টেকনাফ সীমান্তেরই রয়েছে ৯ শতাধিক ইয়াবা কারবারি।
পাঠকের মতামত: