প্রদীপ ও লিয়াকতের অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনী নেবে কেন?
:: এম.আর মাহমুদ ::
গেল দু’সপ্তাহ ধরে ইয়াবাসহ মাদক বিরোধী অভিযান তেমন চোখে পড়ছে না। মনে হচ্ছে দেশে ইয়াবা ও মাদক পাচারকারীরা ভাল হয়ে গেছে। কক্সবাজারের এসপি এবিএম মাসুদ হোসেন ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে কক্সবাজার জেলা ইয়াবামুক্ত হবে।
জেলার সব শ্রেণির মানুষ আশান্বিত হয়েছিল ইয়াবার অপবাদ থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু কতিপয় অতি উৎসাহী পুলিশের একটি ভুলের কারণে ইয়াবা পাচারকারীরা অনেকটা নিরাপদে রয়েছে।
টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপের নির্দেশে বাহার ছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানের করুণ মৃত্যুতে ইয়াবা বিরোধী অভিযান চাপা পড়ে গেছে।
বিশেষ করে মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যার পর টেকনাফ থানার বহু বিতর্কিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ অন্তত ১০ পুলিশ এখন আইনের জালে আটকা। এ কারণে পুলিশ সারাদেশে ইয়াবা ও মাদক বিরোধী অভিযানে আগ্রহ হারিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। যা দেশের জন্য কল্যাণকর নয় বলে বিজ্ঞজনদের অভিমত।
পুলিশের কাজ দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে বিধিসম্মত ভাবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী হয়ে নর হত্যার মত অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কোন সুযোগ নেই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে।
পুলিশ আইনের বিধান মোতাবেক অপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের জন্য আদালতে প্রেরণ করে থাকে। আদালত সাক্ষী প্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে বিচার কার্য সম্পাদন করে থাকে। টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ দাশ চট্টগ্রাম মহানগর থেকে কক্সবাজারের বেশ ক’টি গুরুত্বপূর্ণ থানায় চাকুরি করেছে।
চাকুরিকালীন অবস্থায় তার আচরণ কোন সময়ই মানবিক ছিল না। গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে প্রদীপ ২৪ বছরের চাকুরি জীবনে অঢেল সহায়-সম্পদের মালিক। তবে তিনি খুবই সুচতুর। তার অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদগুলো নিজের নামে না করে স্ত্রীর নামেই করেছে। স্ত্রী একজন গৃহিনী তিনি এত সম্পদের মালিক হলেন কিভাবে? তার কি আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ আছে। প্রদীপ ঠিকই আছে তিনি হচ্ছেন তার স্বামী।
প্রদীপ ও লিয়াকতের নির্মম হত্যার শিকার অবসর প্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানের কারণে হয়তো তারা মারাত্মকভাবে হোচড় খেয়েছে। এ হোচড়ের মাশুল দিতে হচ্ছে পুরো পুলিশ বাহিনীকে। আমজনতার অভিমত, প্রদীপ লিয়াকতের অপকর্মের দায় পুরো পুলিশ বাহিনী নেবে কেন? ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশ আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সচেষ্ট। পুলিশ ছাড়া আইন শৃঙ্খলা রক্ষা কল্পনাও করা যায় না। মানবিক এক পুলিশের দারোগা রফিজ উদ্দিনের হাত ধরে চায়ের দোকানের রুটির হামিল তৈরির কাজ থেকে নিয়ে গিয়ে নিজের তত্ত্বাবধানে স্কুলে ভর্তি করে না দিলে হয়তো বিদ্রোহী কবি নজরুল কবি হতে পারতেন না।
এ ছাড়া করোনাকালীন সময় পুলিশের মহানুভবতা সাধারণ মানুষ দেখেছে। যে কারণে পুলিশ বাহিনী প্রশংসিতও হয়েছে। হাতেগোনা কিছু পুলিশের (হুতুম পেঁচা) কারণে পুরো বাহিনীর সম্মান ভুলুন্ঠিত হতে পারে না। সাধারণ মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন নির্ঘুম রাত কাটিয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। রাস্তার পাগলী যখন প্রসব বেদনায় রাস্তায় কাতরায় তখন পুলিশের অনেক সদস্য এসব বিপণ্ন পাগলীকে সদ্য প্রসব করা সন্তানসহ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করতেও কৃপণতা করে না। যার প্রমাণ বেশুমার।
প্রসঙ্গক্রমে না বললে হয় না, চকরিয়া উপজেলার দক্ষিণ কাকারা গ্রামের মোহাম্মদ ইব্রাহীম নামক একজন কৃষককে চকরিয়া থানা পুলিশ ঢাকাস্থ মিরপুর থানায় একটি অস্ত্র মামলায় (গ্রেফতারী পরওয়ানাভূক্ত) গ্রেফতার করেছিল। আমরা কয়েকজন সংবাদকর্মী চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দপ্তরে গিয়ে বিষয়টি জানতে চাইলাম, তিনি বললেন ওই আসামীকে অস্ত্র মামলার গ্রেফতারী পরওয়ানা মিলে গ্রেফতার করা হয়েছে। তখন আমি বলতে বাধ্য হলাম, ওই কৃষক জীবনে ঢাকায় যায়নি।
সে কিভাবে অস্ত্র মামলার আসামী হতে পারে? তখন ওসি হাবীব, স্বপ্রণোদিত হয়ে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলেন ইস্যুকৃত গ্রেফতারী পরওয়ানায় উল্লেখিত নাম্বারে কোন মামলায় রেকর্ড হয়নি। তখন তিনি নিশ্চিত হলেন, গ্রেফতারী পরওয়ানাটি ভূঁয়া। পরে থানা হাজত থেকে গ্রেফতারকৃত কৃষককে নিজ দপ্তরে এনে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করে আমার জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে। অথচ ওসি সাহেব ইচ্ছা করলে ওই কথিত আসামীকে আদালতে পাঠালে আইনগতভাবে মোকাবেলা করে বের হয়ে আসতে তার সহায়-সম্বল বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকত না।কিন্তু তিনি নিজের দায়িত্ব বলে ওই কৃষকের প্রতি সদয় হয়ে এ মহানুভবতা দেখিয়েছেন।
প্রদীপ কর্তৃক দেয়া ক্রসফায়ারে প্রাণ হারানো সব লোকেই যে ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল তা নয়। তার নির্মমতার কারণে অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ক্রসফায়ারের নামে হত্যার শিকার অসংখ্য পরিবারের আর্তনাদে সৃষ্টিকর্তার আরশ কাঁপছে।
টেকনাফের আলোচিত পৌর কাউন্সিলর একরামের হত্যাকান্ডের পর ভাইরাল হওয়া একটি চিত্র বার বার মনে পড়ে। যা ছিল অতি নিষ্ঠুর ও নির্মম। সে বিচার কি একরামের পরিবার কোনদিন পাবে? যাক ওইসব পুরনো কথা বলে কোন প্রতিকার পাওয়া যাবে না। মনির চৌধুরীর কথায় বলতে হয় ‘মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়।’ প্রদীপের অপকর্মের কারণে সারাদেশে প্রতিদিনই কোন না কোন থানার পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হচ্ছে। এসব মামলার কারণে পুলিশ অনেকটা হতাশ হয়ে দায়িত্ব পালনে ঝুঁকি নিচ্ছে না।
ফলে মাদক পাচারকারীরা এখন নিজেদেরকে অনেকটা সুরক্ষিত মনে করছে। সীমান্ত পথে ইয়াবার চালান দেশের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত প্রবেশ করছে। সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি ও র্যাবের হাতে ইতিমধ্যে বড় বড় কয়েকটি চালান ধরা পড়েছে।
তারপরও ইয়াবাসহ মাদক পাচার একেবারে বন্ধ হয়ে পড়েছে তা কল্পনা করা যায় না। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা ও মাদক ব্যবসায়ীদের উল্লাস নিত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সে ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অধিকতর তৎপর না হলে এদেশের যুব সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিরোধী। কারণ এতে অনেক নিরীহ মানুষ বলির পাঠা হচ্ছে। অপরাধীদেরও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রয়েছে।
লেখক: এম.আর মাহমুদ, দৈনিক সমকাল. চকরিয়া প্রতিনিধি ও
সভাপতি -চকরিয়া অনলাইন প্রেসক্লাব, চকরিয়া. কক্সবাজার।
পাঠকের মতামত: