ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

আ. লীগে বিকল্প প্রার্থীর দাবি বিএনপিতে একক প্রার্থী (উখিয়া-টেকনাফ আসন)

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ::

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-৪ সংসদীয় আসন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশের সীমান্তবর্তী এ দুই উপজেলার পরিচিতি এখন বিশ্বব্যাপী। সেই সঙ্গে মাদক বড়ি ইয়াবা কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ নিয়ে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এই আসনের এমপি আবদুর রহমান বদির নামটিও বহুল বিতর্কিত। এ কারণে এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এবার অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে বলে ছেলে-বুড়ো সবার মুখে মুখে আলোচনা আছে।

বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া অন্য দলের তেমন কোনো প্রার্থীর কথা শোনা যাচ্ছে না এ আসনে। মনোনয়ন এবং প্রার্থী হিসেবে দৌড়ঝাঁপে রয়েছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন। তবে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। তাদের শুধু একজনের নামই শোনা যায়।

উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার মানুষের মধ্যে আরো একটি আলোচনা আছে। সেটি তাদের ‘ভাগ্যবান আসনের’ ভাগ্য-দুর্ভাগ্য নিয়ে। তারা মনে করে, এটি একটি ভাগ্যবান আসন। বলা হয়ে থাকে, এ আসনটিতে যে দল জয়লাভ করে সে দলই সরকার গঠন করে। দীর্ঘদিন ধরে এটাই হয়ে আসছে। কক্সবাজার জেলায় অন্যতম মর্যাদার এ আসনটি তাই দেশের দুই প্রধান দলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ।

আওয়ামী লীগ : মিয়ানমারের লাগোয়া হওয়ায় ভৌগোলিক কারণেও এ আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতন সমাজের মতে, এ আসনে সংসদ সদস্য হওয়া প্রয়োজন একজন বিদগ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের। যিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে জ্ঞানী হবেন। হবেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তিনি মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের স্বপ্ন লালন করবেন। কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা, রোহিঙ্গা সমস্যা ও মাদক সমস্যা লেগেই রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে অভিশাপ হিসেবে পরিচিত ইয়াবা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে এলাকাটিতে এমপি পদে একজন সৎ মানুষের খোঁজের কথা বারবার উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের কথায়।

এলাকার লোকজনের অভিযোগ রয়েছে, দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারির সংখ্যা নেহাত কম নয়। বিশেষ করে সীমান্তের উখিয়া ও টেকনাফে প্রচুরসংখ্যক ইয়াবা কারবারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ আসনে গত দুইবারের নির্বাচিত আওয়ামী লীগদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদি নিজের ইচ্ছামাফিক দল চালাতে গিয়ে এক ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন। দলে ঢুকে পড়েছে ইয়াবা কারবারিসহ সমাজবিরোধী লোকজনও। ফলে প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের সঙ্গে এমপি বদির মধ্যে পাহাড়-পর্বত সমান দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল বাশারের সঙ্গে এমপি বদির মধ্যকার সম্পর্ক এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে বদির সঙ্গে তাঁদের মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত নেই। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় থেকে তাঁদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অভিযোগ রয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকেই এমপি বদি মনোনয়নের ব্যবস্থা করায় দলীয় লোকজন তাঁর কাছ থেকে সরে পড়তে শুরু করে। এ ছাড়া দলীয় লোকজনের চেয়ে সীমান্ত এলাকার বিশেষ বিশেষ ব্যবসায়ী বদির ‘আপনজন’ বলে অভিযোগ করে থাকে নেতাকর্মীরা।

গত ১০ আগস্ট উখিয়ায় ১৫ আগস্ট স্মরণে আয়োজিত সভায় খোদ এমপি বদির শ্যালক ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীও প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার বোন বিয়ে দিয়েছি শুধু আপনার কাছে। আত্মীয়তায় আপনি আমার দুলাভাই। তার মানে এই নয়, আপনার কাছে আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ এবং বিবেক বন্ধক দিয়ে দিয়েছি।’ এর আগে জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বদির কারণেই মিয়ানমারের ইয়াবা নিয়ে দেশের লাখ লাখ যুবক আজ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তিনি জাতিকে ডুবিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের ভাবমূর্তিরও ক্ষতি করেছেন।’

বলা হচ্ছে, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আওয়ামী লীগ বহুদিন ধরেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে রয়েছে। একদিকে প্রকৃত আওয়ামী লীগ এবং অন্যদিকে হাইব্রিড আওয়ামী লীগ। বদির নেতৃত্বাধীন নেতাকর্মীরাই হাইব্রিড হিসেবে পরিচিত। কারো কারো কাছে বদির নেতৃত্বাধীন নেতাকর্মীরা ‘বদি লীগ’ হিসেবেও পরিচিত। হাইব্রিড তথা বদি লীগ হিসেবে পরিচিতদের বেশির ভাগই রয়েছেন দলের বিভিন্ন পদমর্যাদায়। অন্যদিকে তৃণমূলেই রয়েছে প্রকৃত আওয়ামী লীগের কর্মীরা। এসব কারণে দলের নেতাকর্মীদের তরফে প্রকাশ্যে বিকল্প প্রার্থীর দাবি উঠেছে। সম্প্রতি উখিয়া উপজেলা সদরে তাঁতী লীগ আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তারা আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, আগামী নির্বাচনে বদিকে আবারও মনোনয়ন না দিয়ে দল ও জাতির ভাবমূর্তি রক্ষা করা হোক।

এ প্রসঙ্গে টেকনাফ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বাশার বলেন, ‘আমরা টেকনাফ সীমান্তের লোকজন ভীষণ কষ্টে রয়েছি। ইয়াবা সম্পৃক্ত একজন এমপিকে নিয়ে আমাদের বদনাম দিন দিন বাড়ছে। এ রকম বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে এবার আমরা মুক্ত হতে চাই।’ উখিয়া উপজেলা সদরের বাসিন্দা এবং বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা জাফর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারপ্রধান যেহেতু মাদকসহ ইয়াবা নিয়ন্ত্রণে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, সে জন্যই ইয়াবা সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের আর কোনোভাবেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া উচিত হবে না।’ উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ছেনুয়ারা বেগম বলেন, ‘ইয়াবা সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকা কোনো ব্যক্তি যদি আবারও দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বসেন তাহলে দেশ ও জাতি ইয়াবামুক্ত হতে পারবে না।’

এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ থেকে বদির মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে কিছুটা সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর আপন পাঁচ ভাইসহ পরিবারের ২৫ জন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির বিরুদ্ধে রয়েছে সরাসরি ইয়াবাপাচারের অভিযোগ। যদিও বদি বারবার ইয়াবা সম্পৃক্ততার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে আসছেন।

এ অবস্থায় দলীয় লোকজন খুঁজছে বিকল্প প্রার্থী। সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী যুবলীগের নবনির্বাচিত সভাপতি সোহেল আহমদ বাহাদুরের নাম তরুণ প্রার্থী হিসেবে জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি সত্তরের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত টেকনাফের অ্যাডভোকেট নুর আহমদের বড় সন্তান। সেই নির্বাচনে নুর আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমমন্ত্রী মৌলভী ফরিদ আহমদকে পরাজিত করেছিলেন। প্রয়াত নুর আহমদ কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও একাত্তরে কক্সবাজার মহকুমা মুক্তিসংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সোহেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন।

সেই সঙ্গে আসনটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য সাবেক দলীয় এমপি ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী এবং এমপি বদির শ্যালক ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর নামও আলোচনায় রয়েছে। আসনটিতে এই প্রথমবারের মতো একজন নারী নেত্রীও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন তাঁতী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী সাধনা দাশ গুপ্তা।

সাধনা দাশ গুপ্তা বলেন, ‘এমপি আবদুর রহমান বদির কারণেই দেশ আজ ইয়াবার মতো ভয়াল মাদকের কবলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাই আর এমপি বদি নয়।’ এলাকায় বলাবলি রয়েছে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা ও কাতারপ্রবাসী বুদ্ধিজীবী ড. হাবিবুর রহমানের কথাও। এরই মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীরা গণসংযোগ, কর্মী সভা, উঠান বৈঠক ইত্যাদি করছেন।

বিএনপি

আসনটিতে বিএনপি তাদের একক প্রার্থী নিয়ে খোশমেজাজে রয়েছে। এই প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক হুইপ ও দল থেকে চারবারের নির্বাচিত এমপি শাহজাহান চৌধুরী। তিনি বর্তমানে কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি। শাহজাহান চৌধুরী বলেন, তিনি স্বচ্ছ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। দল, দেশ ও জাতির ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে তিনি বিরত রয়েছেন।

১৯৯১ সালে এই আসনে জয়লাভ করেছিলেন বিএনপি প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরী। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শাহজাহান চৌধুরীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ আলী। ২০০১ সালের নির্বাচনে মোহাম্মদ আলীকে পরাজিত করে আবার বিএনপির শাহজাহান চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শাহজাহান চৌধুরীকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের আবদুর রহমান বদি এবং পরে ২০১৪ সালেও বদি দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন।

কক্সবাজার-৪ আসনের মোট ভোটারসংখ্যা দুই লাখ ৬২ হাজার ৪৭৯ জন। টেকনাফ উপজেলায় ভোটারসংখ্যা এক লাখ ৪৪ হাজার ১৫৭ জন ও উখিয়া উপজেলায় এক লাখ ১৮ হাজার ৩২২ জন।

পাঠকের মতামত: