শাহেদ মিজান, কক্সবাজার :: ‘সারা দিন ঘুমোট পরিবেশ। গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয় সারা দিন। সাথে হালকা গোলমেলে বাতাস। সূর্যের দেখা মেলেনি সারা দিন। বিকাল হতেই বাতাস বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বাতাস আরো বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে পারেনি। রাত ৯টার দিকে বাতাসের বেগ বেড়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচন্ড বাতাস শুরু হয়। বাতাসে ঘরের চালা উড়ে যাচ্ছে। বেড়িবাঁধের নিচে পানি চলে এসেছে। ঘন্টখানেকের মধ্যে পানি বেড়িবাঁধ উপচে উঠে এবং বসতবাড়ি তলিয়ে নিয়ে যায়। পানির সাথে ভেসে যায় আমার মা-বাবা, একবোন ও দু’ভাই। তবে ভাগ্যগুণে পাশের একটি বটগাছে আটকে বাবা বেঁচে যায়।’
ঘূর্ণিঝড়ের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে যাওয়া পিতা মো. ইউসুফ আলীর উদ্ধৃতি দিয়ে ছলছল চোখে কথা গুলো বলছিলেন মো. ইউনুছ (৪৬)। তিনি এখন কক্সবাজার শহরের সমিতি পাড়ায় বসবাস করছেন। ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি কক্সবাজারে ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি তার পরিবার কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবর ডেইলের খুদিয়ারটেকে ছিলেন।
মো. ইউনুছ বলেন, ‘কুতুবদিয়া থাকলে হয়তো আমিও মারা যেতাম। কিন্তু আমি বেঁচে আছি তবে মৃতের মতো বেঁচে আছি। কারণ মা আর তিন ভাইবোনকে হারিয়ে আমার জীবনটা চিরতরে শূন্য হয়ে গেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কারণে তিনদিন পর কুতুবদিয়া যেতে পারি। গিয়ে দেখি পুরো কুতুবদিয়া বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। যেদিকে তাকাই শুধু লাশ আর লাশ। মানুষ ও গরু-ছাগলের লাশ একাকার হয়ে গেছে। তখন পর্যন্ত জানি না। আমার মা-বাবা ও ভাইবোনেরা কেমন আছেন। এলাকায় পৌঁছে দেখি আমাদের বাড়িটি নেই। একদম সবকিছু তলিয়ে নিয়ে গেছে পানিতে। মা-বাবা ও ভাইবোনকে খোঁজে পাচ্ছি না। আশেপাশের লোকজনও কেউ বলতে পারছে না। উপরন্তু অনেকে স্বজন হারিয়ে পাগলপ্রায়। শেষ পর্যন্ত খবর পেলাম। বাবা বেঁচে আছেন। তাঁকে গাছ থেকে নামিয়ে দূরবর্তী আত্মীয়রা তাদের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। পরে বাবার কাছ থেকে সব ঘটনা জেনেছি।’
এরপর আর কুতুবদিয়ায় থাকেননি মো. ইউনুছ। একমাত্র স্বজন বাবাকে নিয়ে চলে আসেন কক্সবাজার শহরের সমিতি পাড়ায়। কিন্তু দু’বছরের ২ বছরের মাথায় ১৯৯৩ সালে ইউনুসকে একা রেখে বাবাও পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
মো. ইউনুস বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর মনে হতো আর কেউ রইল না। তাহলে আমি কার জন্য রইলাম। তখন মরে যেতো ইচ্ছে করতো। আমার এই অবস্থা দেখে আত্মীয়-স্বজনেরা আমাকে বিয়ে দেন। বাবা মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় আমি বিয়ে করি। আমার চার ছেলেমেয়ে রয়েছে। তাদের নিয়ে জীবন পার করছি। তবে বয়ে বেড়াচ্ছি স্বজন হারানোর সেই ক্ষত।’
মো. ইউনুসের স্বজন হারানো অনেক মানুষ বাস করছে কক্সবাজার শহরেরর ১নং ওয়ার্ডে। যাদের প্রত্যেকের জীবনে রয়েছে স্বজন হারানো এরকম মর্মস্পর্শী গল্প। তারা সবাই ক্ষত নিয়ে পার করছেন বেদনাবিধুর জীবন।
সেই ভয়াল দিন আজ ২৯ এপ্রিল। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য এক দুঃসহ স্মৃতি ও শোকাবহ দিন। ২৬ বছর আগে ১৯৯১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের উপকুলে আঘাত হানে স্মরণকালের ভয়াবহতম প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। যার আঘাতে মারা যায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ। যদিও সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা দেড় লাখের মতো। ঘূর্ণিঝড়ের পর এক মাসের মধ্যে এর প্রভাবে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরো লক্ষাধিক মানুষ। সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর তান্ডবে শুধু মানুষই নয়, লক্ষ লক্ষ গবাদী পশু, ফসল, বিপুল পরিমাণ স্থাপনা, সম্পদ ধ্বংস হয়।
আকস্মিক সেই ঘূর্ণিঝড়ে উপকূল পড়েছিল লাশের মিছিল। চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল গিয়েছিল লাশ আর লাশ। সেই সাথে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এই ধ্বংসলীলা দেখে কেঁপে উঠেছিল বিশ্ববিবেক। অনেকে চিরতরে হারিয়েছে স্বজন, সহায়-সম্বল ও আবাসস্থল। এখনো তারা সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা ভুলতে পারেনি।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও মহেশখালীই প্রলংয়কারী ঘূর্ণিঝড়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই অপূরণীয় ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখানকার অধিবাসীরা।
স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের তান্ডবের শিকার হয় দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব উপকুলীয় অঞ্চল কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, মহেশখালী, সন্দ্বীপ, ভোলা, ফেনী, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরিশালসহ ১৩টি জেলার ৭৪টি উপজেলার দেড় কোটি মানুষ। ওইদিন রাতে পূর্ণিমার ভরা জোয়ার থাকায় ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত হয়ে উঠেছিল আরো সর্বগ্রাসী ও প্রাণহানিকর।
ঘণ্টায় ২৩৫ কিলোমিটার বেগে প্রায় ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু এ সাইক্লোনের আঘাতে সে কালরাত্রিতে ছিনিয়ে নেয় ৫ লাখ মানুষের জীবন। যাদের ৪ ভাগের ৩ ভাগই ছিল শিশু ও নারী। এদেশের মানুষ ইতিপূর্বে ঝড় ও ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে কম-বেশি পরিচিত ছিল, কারণ প্রতিবছরই এখানকার মানুষকে এ ধরনের ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হয়। এবং প্রতি দুর্যোগেই জীবন দিতে হয় অসংখ্য মানুষকে।
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ১৫৮৪ সালের পর ১৯৬১ সালে গৌর্কির মরণ ছোবলে প্রায় ৬০ হাজারের অধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলে। এর পর এ অঞ্চলে সাইক্লোন, হ্যারিকেন, জলোচ্ছ্বাস ঘটে ১৭ বার। যার সর্বশেষ পুনরাবৃত্তি ঘটে ২৯ এপ্রিল ১৯৯১-এর সোমবার রাতে। এ গৌর্কির আঘাত ছিল সর্বাধিক নির্মম। এ ধ্বংসলীলা ৭০-এর প্রলয়ঙ্কারী গৌর্কির চেয়েও ছিল বেশি শক্তিশালী ছিল। ফলে ক্ষতির পরিমাণও ছিল সর্বাধিক। এ ধ্বংসযজ্ঞ শুধু মানবশক্তির ক্ষয় করেনি বরং অচল, নিথর, নিস্তব্ধ করে দিয়েছে সব জনপদ। শিল্পবাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এদিকে উপকূলজুড়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের ২৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো সেই উপকূলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। বেড়িবাঁধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের মধ্যে চরম আতঙ্কে বাস করছে সেখানকার মানুষ। এখনো প্রতি বর্ষায় নির্ঘুম রাত কাটান তারা।
সেই জনসংখ্যার তুলনায় পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়নি। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই পর্যন্ত নির্মিত বেড়িবাঁধ হয়নি পরিকল্পনা অনুযায়ী। নেই রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা। ফলে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবছর সৃষ্টি হয় ভাঙন। আবার সংস্কারকাজে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর সরকারি বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, ২৯ এপ্রিলের জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের ৪৬০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ১৫৪ কিলোমিটার ভেঙে যায়। এরমধ্যে ৫৮ কিলোমিটার বাঁধের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। ২৮ বছর পরও এখনো অরক্ষিত রয়েছে বেশির ভাগ বেড়িবাঁধ।
সূত্র জানায়, ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তীতে ৩৮টি দেশের বিভিন্ন দাতাসংস্থা থেকে ৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার সাহায্য আসে। ওই টাকায় আশ্রয়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিদেশি অনুদানে ৩ হাজার ৬০০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কথা থাকলেও হয়েছে ১ হাজার ২০০-এর মতো। এরমধ্যে শতাধিক কেন্দ্র সাগরে তলিয়ে গেছে। চট্টগ্রাম প্রায় ৩৯১টি নতুন আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছিল। তার মধ্যে চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ কয়েকটি উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ৬৩টির মতো কেন্দ্র তলিয়ে গেছে। এখনো সামান্য জোয়ারে পানি ঢুকে পুরো উপকূলীয় এলাকা সয়লাব হয়ে যায়। রাজনৈতিক দলের নেতাদের আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ওয়াদাও বাস্তবায়ন হয়নি।
২৯ এপিল স্মরণে প্রতিবছর কক্সবাজারে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। এই বছরও সেসব কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে। কর্মসূচীর অন্যতম দাবি উপকূলবাসীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা।
পাঠকের মতামত: